কাজী নজরুলের ‘সঞ্চিতা’, রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’—যা সবার জানা দরকার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নজরুল বয়সে ৩৮ বছরের ছোট হলেও দুজনের সম্পর্ক ছিল গভীরতম। দুজনের দুটি কাব্যগ্রন্থ সংকলনের নাম প্রায় একই। নজরুল তাঁর নির্বাচিত কবিতা ও গান নিয়ে সংকলন করেন ‘সঞ্চিতা’ নামে আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থ নিয়ে প্রথমে ‘চয়নিকা’ পরবর্তী সময়ে ‘সঞ্চয়িতা’ করেন। অনেকেই হয়তো জানেন, ‘সঞ্চিতা’ কবি নজরুলের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ সংকলন ‘সঞ্চয়িতা’ প্রকাশ পায়। এই ধ্রুব সত্য কথা অনেকেই জেনেও স্বীকার করতে চান না।

১৯০৯ সালের রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে ‘চয়নিকা’ প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিগুরু এর সময়ের মধ্যে যে কটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, সেখান থেকে ১৩০টি কবিতা নিয়ে এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেসে তা মুদ্রিত হয়। কবির ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। এরপর ১৯২৫ সালে বিশ্বভারতী ‘চয়নিকা’র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এতে কবিতার সংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কবিতা নির্বাচনের রীতিও পরিবর্তন করা হয়। নতুন কলেবরে ‘চয়নিকা’ নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হলো। রবীন্দ্রনাথের এই সংকলনের কবিতা পরিবর্তন, বৃদ্ধির করার বিষয়টি পছন্দ হলোও নির্বাচন পদ্ধতি কবির পছন্দ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাই ভাবতে লাগলেন নতুনভাবে কিছু করার।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’

এর মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পরিকল্পনা করে ফেলেন ‘সঞ্চিতা’ নামে কাব্যগ্রন্থের। তিনি তাঁর নির্বাচিত ৭৮টি কবিতা ও ১৭টি গান নিয়ে ‘সঞ্চিতা’ বের করার উদ্যোগ নেন। ১৯২৮ সালের (আশ্বিন ১৩৩৫) অক্টোবর মাসে ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশিত হয়। নজরুলের এই কাব্যসাহিত্য সংকলন পাঠকের মধ্যে ব্যাপক সমাদৃত হলো।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাসখানেক আগে লিখিত এক পত্রে এই গ্রন্থকে ‘আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া রচিত পুষ্পাঞ্জলি’ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ওই পত্রে এই গ্রন্থের নামকরণ প্রসঙ্গেও লিখেছেন, ‘আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভাল যেগুলি—সেইগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি “সঞ্চিতা” নাম দিয়া।’

প্রসঙ্গত,কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’ গ্রন্থের দুটি সংস্করণ প্রায় একই সময়ে মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকা অনুযায়ী বর্মণ পাবলিশিং হাউস ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ করে ২ অক্টোবর ১৯২৮ তারিখে। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ২+১৩০ এবং মূল্য ছিল দেড় টাকা। এতে ‘অগ্নি-বীণা’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণি-মনসা’, ‘ছায়ানট’, ‘দোলন-চাঁপা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ ও ‘চিত্তনামা’ গ্রন্থ থেকে কবিতা ও গান সংকলিত হয়। ১৪ অক্টোবর, ১৯২৮ তারিখে ডি এম লাইব্রেরি কর্তৃক প্রকাশিত হয় ‘সঞ্চিতা’র আরেকটি সংস্করণ। এই সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩+২২৩ এবং মূল্য ছিল আড়াই টাকা। ডি এম লাইব্রেরির এই সংস্করণে যে কটি গ্রন্থ থেকে কবিতা ও গান সংকলিত হয় সেগুলো হলো ‘অগ্নি-বীণা’, ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণি-মনসা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চিত্তনামা’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘বুলবুল’ ও ‘জিঞ্জির’। ‘সঞ্চিতা’র এই সংস্করণে ৭৮টি কবিতা ও ১৭টি গান সন্নিবেশিত হয়েছে।

‘সঞ্চিতা’ প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ও তৎকালীন ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করার জন্য কবি নজরুল চিঠি লিখে অনুমতি চেয়েও অনুমতি না পেয়ে ‘সঞ্চিতা’র ডি এম লাইব্রেরি সংস্করণ উৎসর্গ করা হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

উৎসর্গ পত্রে লেখা হয়—
বিশ্বকবিসম্রাট
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু—

‘অধুনা বাংলাদেশে “সঞ্চিতা” গ্রন্থের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ঢাকাস্থ কবি নজরুল ইনস্টিটিউট এর নতুন সংস্করণ প্রকাশে উদ্যোগী হয়। এতে ডি এম লাইব্রেরি প্রকাশিত “পঞ্চম সংস্করণ”-এর পাঠ অনুসরণ করা হয়েছে এবং ডি এম লাইব্রেরি প্রকাশিত “সঞ্চিতা”র সপ্তপঞ্চাশৎ সংস্করণের দ্বিত্ব-বর্জিত সংশোধিত সংস্করণের বানান রক্ষিত হয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’

নজরুলের এই ‘সঞ্চিতা’ যখন পাঠকপ্রিয়তা তুঙ্গে, তখন কবিগুরু পরিকল্পনা করলেন ‘চয়নিকা’ নাম পরিবর্তন করে তিনি তাঁর কাব্যসংকলনের নাম পরিবর্তন করবেন। এবার কবিতাগুলো সংকলনের দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করলেন। কবিতাগুলো তিনি নির্বাচন করে ১৯৩১ সালে প্রথম ‘সঞ্চয়িতা’ প্রকাশ করেন।

তিনি ভূমিকায় লিখেছেন—
‘“সঞ্চয়িতা”র কবিতাগুলি সংকলনের ভার আমি নিজে নিয়েছি। অন্যের উপরেই দিতাম। কেননা, কবিতা যে লেখে কবিতাগুলির অন্তরের ইতিহাস তার কাছে সুস্পষ্ট। বাহিরের প্রকাশে কবিতাগুলি উজ্জ্বল হয়েছে কি না, হয়তো সেটা তার পক্ষে নিশ্চিত বোঝা কোনো কোনো স্থলে সহজ হয় না।

কিন্তু, এই সংকলন উপলক্ষ্যে একটি কথা বলবার সুযোগ পাব প্রত্যাশা করে এ কাজে হাত দিয়েছি। যারা আমার কবিতা প্রকাশ করেন অনেক দিন থেকে তাঁদের সম্বন্ধে এই অনুভব করছি যে, আমার অল্প বয়সের যেসকল রচনা স্খলিত পদে চলতে আরম্ভ করেছে মাত্র, যারা ঠিক কবিতার সীমার মধ্যে এসে পৌঁছায়নি, আমার গ্রন্থাবলীতে তাদের স্থান দেওয়া আমার প্রতি অবিচার।” তিনি আরও বলেন, ‘আমার লেখা যে-সকল কাব্যগ্রন্থ দীর্ঘকাল পাঠকদের পরিচিত এই গ্রন্থে তাদেরই থেকে বিশেষ করে সংগ্রহ করা হয়েছে। যেগুলি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত, সেগুলি যথাস্থানে পূর্ণতর পরিচয়ের অপেক্ষায় রইল।’ (সঞ্চয়িতা, ভূমিকা, শান্তিনিকেতন, পৌষ ১৩৩৮)

আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ কাব্যসংকলনের অনুপ্রেরণায় তিনি তাঁর কাব৵সংকলনের নামকরণ করেন ‘সঞ্চয়িতা’।

তথ্যসূত্র

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’

২. কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’

৩. ড. মইনুল হাসানের ‘ একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প’

৪. রবীন্দ্র রচনাবলী

*লেখক: আবু সাঈদ, কবি, প্রকাশক