চলচ্চিত্র আলোচনায় স্মরণ, মেঘে ঢাকা তারা

১৯৬০ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতায় মুক্তি পায় ঋত্বিক কুমার ঘটকের বাংলা ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এটি তাঁর নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে চতুর্থ, যা মুক্তির পর থেকে বিশ্বের দরবারে আরও বিষদ ক্যানভাসজুড়ে আলোচনায় উঠে আসেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। তাই বলা চলে, সেই সমসাময়িক প্রেক্ষাগৃহ থেকে নির্মাণ করা এ ছবি প্রাপ্তির আনন্দ বয়ে আনে কর্মশৈলীতে, যা পরবর্তী সময়ে এ ছবির সাফল্য তাঁর ভাবনার জগৎ করেছে আরও প্রসারিত।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত মেয়ে নীতা। তার দূরদর্শী অভিনয়শৈলী ছবির প্রতি দর্শকের ভাবনাকে করেছে আরও বেগবান। তাই এ ছবির ব্যবসাসফলতার পেছনে নীতার চরিত্রটি অনেকাংশে মেটাফোর হিসেবে কাজ করছে ...

নীতা চরিত্রটি গভীরভাবে অবলোকন করলে আমরা দেখতে পাই, তৎকালীন প্রগতিশীল একটি মধ্যবিত্ত জীবন থেকে তুলে আনা চরিত্র সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে এমএ পড়ুয়া মেয়ে নীতা, যে সারা দিন টিউশনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে, মাস শেষে বেতনের শেষ কটা টাকা তুলে দেয় মায়ের আঁচলে, ছোট ভাইবোনের পড়ার খরচ, বড় ভাই শংকরের ভেতর লুকিয়ে থাকা সংগীতের সুপ্ত প্রতিভা সদা জাগ্রত করতে সর্বক্ষণ অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং মাঝেমধ্যে চুল–দাড়ি কামানোর জন্য আটানা কিংবা এক পেটি, কখনোবা দাদার জন্য পাঞ্জাবির কাপড় কিনে আনা। মোটকথা সংসারের ঘানি টানতে টানতে স্বপ্ন দেখা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল নীতা। তবু কোনো এক দিন সংসারের চিত্র বদলাবে, পরিবারের সবাই কর্মক্ষম হবে—সবার মুখে হাসি ফুটবে, এমন অনাগত স্বপ্ন অবলম্বন করে বেঁচে থাকে নীতা; চলে তার জীবনসংগ্রাম। তার অদম্য ধৈর্যশৗলতা দর্শকহৃদয়ে যতটা না দাগ কাটে, তার চেয়ে বেশি লাস্টস্টেজে ধরা পড়া টিবি রোগ হওয়ার পর যখন সে কেবল একা হয়ে যেতে থাকে সবার অগোচরে। তারও আগে দর্শক বলা যায় হাইলি ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে—এরপর কী হতে যাচ্ছে, কিংবা কী হবে। মূলত দেশভাগের পরবর্তী সমসাময়িক পটভূমির ওপর দাঁড় করিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক; সে সময়ের উদ্বাস্তুদের কথা, সৃষ্ট নতুন শহরের বাস্তবতা সবকিছু মিলিয়ে ছবিটি বানানোর ব্যাপারে ঋত্বিক ঘটক ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন, যা তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

ছবিটির চিত্রনাট্যে মৃণাল সেনের মুনশিয়ানার পরিচয় মেলে, যা এখনো আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ বিচার করে মেঘে ঢাকা তারাকে। এখানে আমরা দেখতে পাই গীতা–নীতার ছোট বোন, যে কিনা বিয়ে করে নীতার প্রেমিক সনতকে।

ছবির সংগীতের ব্যাপারে বলতে গেলে রবীন্দ্র গানের সুরলহরি বেজে ওঠে নীতার কণ্ঠে: যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঘরে ...এ ছাড়াও শংকরের গলায় ভারতীয় রাগ তুলে ধরা হয় এবং গ্রামবাংলার বাউলিয়ানা সুর তো রয়েছেই। আমরা দেখতে পাই, নীতা তার প্রিয় দাদাকে সামনে পেয়ে অন্তিম সময়ে চিৎকার করে বলতে চায়: আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই দাদা। সংলাপটির মধ্য দিয়ে কেঁদে ওঠে দর্শকের হৃদয়, নিজের অজান্তেই ভিজে যায় আঁখি...

ঋত্বিক কুমার ঘটকের দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অন্যতম একটি কাজ ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্র।

ঋত্বিক কুমার ঘটক, যিনি ঋত্বিক ঘটক হিসেবে বেশি পরিচিত, (জন্ম: ৪ নভেম্বর ১৯২৫ এবং মৃত্যু: ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়ায়। রাজশাহী শহরের পৈতৃক বাড়িতে শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের একটি অংশ কাটিয়েছেন। এ বাড়িতে কিছু সময় বসবাস করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীও। ঋত্বিক ঘটক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। তিনি রাজশাহী কলেজ এবং মিয়াপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন‌‌। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তিনি সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনীয়। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তিনি যেমন প্রশংসিত ছিলেন, ঠিক তেমনি বিতর্কিত ভূমিকাও রাখেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুল উচ্চারিত।

ঋত্বিক ঘটক তাঁর প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’ লেখেন ১৯৪৮ সালে। একই বছর তিনি ‘নবান্ন’ নামক পুনর্জাগরণমূলক নাটকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটিএ) যোগ দেন। এ সময় তিনি নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন ও অভিনয় করেন এবং বের্টোল্ট ব্রেশট ও নিকোলাই গোগোলের রচনা বাংলায় অনুবাদ করেন। বিমল রায়ের ‘জ্বালা’ নাটকটি তিনি লেখেন এবং পরিচালনা করেন ১৯৫৭ সালে। এটি তাঁর পরিচালনায় শেষ নাটক। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রের জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫১) সিনেমার মধ্য দিয়ে; তিনি একই সঙ্গে অভিনয় করেন এবং সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এর দুই বছর পর তাঁর একক পরিচালনায় মুক্তি পায় নাগরিক। দুটি চলচ্চিত্রই ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে জোর ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিল।

ঋত্বিক ঘটকের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) এবং ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২) অন্যতম। এ তিন চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যার মাধ্যমে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রূঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে। হিন্দু বাঙালি শরণার্থীর দুর্দশার কথা বলা হয়েছে। সমালোচনা এবং বিশেষ করে ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’র ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই দশকে আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ঋত্বিক ঘটকের শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪) অনেকটা আত্মজীবনীমূলক এবং এটি তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্র থেকে ভিন্ন ধাঁচের। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে তৈরি ঋত্বিকের একাধিক ছবিতে মর্মস্পর্শী সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে শিল্পকলায় পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। ৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিন। সত্যিই এ মহান সিনেমা নির্মাতা হৃদয়ে অম্লান থাকবেন অনন্তকাল।
লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ