কাঁটাবন নয়, যেন কুসুমের অঙ্গন
ঘড়ির কাঁটা মেলেনি, কিন্তু হৃদয়গুলো এক মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে।
সেই গল্পই বলছি। শুরুটা রবীন্দ্রসংগীতের কণ্ঠ দিয়ে।
‘আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন!’
পথটি কুসুমকীর্ণ হওয়ার পরও বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি। আমি তার জন্য নিবেদিত। তাকে আমার চাই–ই চাই।
‘আজকে পথে বাহির হব বহি আমার জীবন জীর্ণ।’…
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুস্মিতা আহমেদ মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন।
চলছিল ভজন সরকারের ‘দেশত্যাগের গল্প: উত্তরের দেশে’ নিয়ে আড্ডা-আলোচনা।
বিশ্ববিদ্যালয়–পড়ুয়া মেয়েকে রেখে ভারতে চলে যায় তার পরিবার। মা-ই সাহায্য করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে। খুব ভোরের এই যাত্রায় গেটে বেণু তার মায়ের ছায়ামূর্তি দেখেছিল। ২৮ বছর পর বেণু এ বাড়িতে আসে। এই বাড়ি এখন রাবেয়াদের। বেণুর মনে হয়েছিল তাকে দেখতে মা ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে সেটা ছিল একটি গাছের অংশ। বেণু হু হু করে কেঁদে ওঠে। গল্পকার পাঠককেও কাঁদান। তাঁরাও দেশত্যাগের বেদনায় কাতর বেণুর মতোই।
আজকের কাগজের সাংবাদিক কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার গল্পের টানে তাঁর জীবনের গল্পই বললেন। দেশের মধ্য থেকেও উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলার শিকার হন অনেকে। শিশুকালে বর-বউ খেলার সাথিকে হারান তিনি। জোড়া উচ্ছেদ ঘটে এ ক্ষেত্রে। বাসন্তী আরিচা এলাকায় পাড়ি জমায় পদ্মা। তারপর গোয়ালন্দ থেকে রেলপথে কলকাতা। অন্যদিকে পরবর্তী সময়ে তাঁকেও যেতে হয় মধ্যবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গে। বিভুরঞ্জন দেশের মধ্যে নিজেই এক গল্প।
ভারত বিচিত্রার সাবেক সম্পাদক নান্টু রায়। বলেন, লেখকদের থাকে আলাদা কিছু চাওয়া। সে বেলায় ভজন সরকারের লেখা ছাপতে সম্পাদক-লেখক সম্পর্কের ছন্দপতন হয়নি।
কবি এবং লেখক-সংগঠক ফরিদুজ্জামান। ভজন-ফরিদ কিংবা ফরিদ-ভজন একটি জোড়ার নামও। ঢাকা কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়—দুই জায়গায়ই তাঁরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছেন। সাহিত্যচর্চা ও একই সঙ্গে। আহমদ শরীফ এবং হুমায়ুন আজাদের আড্ডার সদস্যও ছিলেন তাঁরা। ফরিদ বলেন, আড্ডার মধ্য দিয়েই ভজন সরকারের লেখা শাণিত হতে থাকে।
‘শত্রু সম্পত্তি’ গল্পের ভবেশ প্রামাণিকের মুক্তিযোদ্ধা ভাই নরেশ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার আর খোঁজ মেলে না। সে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরোধিতা করেছিল। একদিন তার সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয়ে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছে কি নেই, সেটাই অজানা তার পরিবারের! অথচ সে কিনা দেশের শত্রু! ভবেশ মেলাতে পারে না। ‘৭১–এর খোঁজে’ গল্পে এই হিসাবটিই মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
আড্ডা-আলোচনাটি বসে ২৮ জুন কবিতা ক্যাফে, কাঁটাবনে। কিন্তু না, গুণীজনের পদচারণে কাঁটাবন বদলে যায়। রূপ নেয় কুসুমবনে। অনুষ্ঠান আয়োজনে সভাপতির আসনে ছিলেন সংস্কৃতিজন সুভাষ ভট্টাচার্য। সঞ্চালনা করেন নিমাই সরকার।
‘যুগল কাপালি’ এক নিঃসন্তান দম্পতির টানাপোড়েনের গল্প। মালতি দেবরের সন্তান দুটিকে নিজের সন্তান মনে করেই বেঁচে থাকে। হঠাৎ এক সকালে তারা দেখে অমূল্যরা নেই। ওই পরিবার হিকমত শেখের কাছে বাড়িঘর বিক্রি করে চলে গেছে। বিদায়কালে মালতিদের সঙ্গে দেখা করার মতো সময় হয় না তাদের।
নিমাই গাঙ্গুলী রাজনৈতিক মানুষ। গণমুখী একটি পার্টির সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, দেশত্যাগের কালে ভাই বা প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা না করা সময়ের ব্যাপার নয়। ব্যথা, যন্ত্রণা-ই এর মূল কারণ। তিনি বলেন, দেশত্যাগে হিন্দু বা মুসলমান দুইয়ের বেলায়ই কষ্টটা এক ও অভিন্ন। হিন্দুরা ভোগে বাংলাদেশ ছাড়লে আর মুসলমানের মন পোড়ে ভারত ত্যাগে।
স্থপতি অসিত কুমার সাহা বলেন, ভজন সরকার তিলে তিলে একজন শক্তিমান লেখক হয়ে উঠেছেন। যোগ করেন, এটা তাঁর নিজস্ব অর্জন।
সাংবাদিক অমূল্য কুমার বৈদ্য অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত–এর বই থেকে তথ্য দেন। বলেন, প্রতিদিন ৬৩২ জন মানুষ বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারত যাচ্ছেন। এ এক মনোবেদনা। তিনি ভজন সরকারের মতো সৃষ্টিশীল আবেগঘন লেখকের লেখায় এই বিষয়গুলো আরও উঠে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সাবেক ইউনিসেফ কর্মকর্তা গীতা দাস সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি ব্যাখ্যা করেন। নিজের সমস্যার কথা বলা বা তুলে ধরা সাম্প্রদায়িকতা নয়। অন্যকে আঘাত না করলেই হলো। আর এমন ইতিবাচক বাস্তবতায় চলে আসে সাহিত্য। যে সাহিত্যচর্চা করে সে তো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা আসে। কলকাতার মেয়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ছেলের বিয়ে হয়। তাতে কী? মা মরলে মরবে! গীতা বলেন, সাহিত্য মানুষকে উদার করে।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক গবেষক তপন বাগচী বলেন, দেশত্যাগ করেছেন গল্পকার ভজন সরকার। সাধারণত দেশত্যাগীরা বাইরে থেকে তাঁদের যোগ্যতার সমান সৃজনশীলতার পরিচয় রাখতে পারেন না। শহীদ কাদরী পারেননি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ফিরে এলেন। পরবর্তী সময়ে স্বদেশে অবস্থান করে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তি আমাদের হাজার বছর এগিয়ে নিয়েছে। অন্তর্জাল এখন যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করে দিয়েছে। ভজন সরকারও এ ক্ষেত্রে এই সুযোগ ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবেন।
ভজন সরকার মনে করেন, মানুষে মানুষে বিভক্তি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কারণে। শুধু এ দেশে নয়, ভারতেও আছে এ সমস্যা। বলেন, অভিবাসন হবে স্বাভাবিক, স্বেচ্ছায়। জোরপূর্বক হলেই না কথা। সভ্যতা এগোচ্ছে। মানুষে মানুষে যে বৈষম্য, তা দূর করা মানুষেরই কাজ। মানবিক মূল্যবোধ ছড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। যোগ করেন, যে জাতির সামনে আছে রবীন্দ্র নজরুল, তার আর বাধা কোথায়! আরও জোর দিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগোবে দেশ ও জাতি।
আড্ডা দারুণ জমে উঠেছে। আলাদা এক দ্যুতি ছড়ায় অঙ্গনে। আরও কথা। আরও আরও...। এ আলোচনা যেন শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু সমাপ্তি টানতে হবে। এরই মধ্যে সুস্মিতা আহমেদ কণ্ঠে সুর নিলেন।...যদি প্রেম দিলে প্রাণে কেন তারার মালা গাঁথা।...কণ্ঠ ছুঁয়ে যায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। রাবীন্দ্রিক মর্যাদা পায় সারা অঙ্গন।
নিমাই সরকার: প্রকৌশলী, কথাসাহিত্যিক।