মুহসীন হলের সুবর্ণজয়ন্তী ও প্রথম পুনর্মিলনী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য নির্মিত ১৮টি আবাসিক হলের মধ্যে হাজী মুহম্মদ মুহসীন অন্যতম। ঐতিহ্যবাহী হলটি ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই হিসেবে ২০১৬ সালে হলটি পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করে। ২০১৭ সাল থেকে মুহসীন হলের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু নানা কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে ১০ মার্চ সেই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়। প্রায় তিন মাস আগেই অনুষ্ঠান আয়োজনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয়। দিন তারিখ নির্ধারণ করা হয় চলতি বছরের ১০ মার্চ রোজ শুক্রবার। ৬ মার্চ থেকেই শুরু হয় প্যান্ডেল তৈরি, মঞ্চ তৈরিসহ নানা আনুষঙ্গিক কাজ।
১০ মার্চ সকাল সাতটা, তখনো সূর্য মামা পুরো মাত্রায় কিরণ দেওয়া শুরু করেনি। সেই সময় থেকেই সাবেক শিক্ষার্থীদের আনাগোনা শুরু হয়। তাঁরা জড়ো হতে থাকেন হলের খেলার মাঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে উপস্থিতি। সকাল ৯টার পর প্রায় পুরো মাঠ সাবেক শিক্ষার্থীদের দিয়ে ভরে যায়। শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। সে সময় হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাবেক শিক্ষার্থীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া, ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, কর কমিশনার ফজলুল হক আরিফ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব গোলাম শফিকসহ নানা গুণীজন। প্রধান অতিথি হিসেবে আসন অলংকৃত করেন হলের সাবেক শিক্ষার্থী, বর্তমান সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি তাঁর বক্তব্যে সাবেক শিক্ষার্থীদের দেশ ও জাতির উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। অন্যান্য অতিথিরাও আলোচনা সভায় অংশ নেন। দুপুর ১২টার পরে আলোচনা সভা শেষ হলে শুরু হয় খাওয়াদাওয়া পর্ব। আইটেম ছিল সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে গরুর মাংসের রেজালা, মুরগির রোস্ট, ডিম, চিংড়ি মাছ, চায়নিজ সবজি ও ডাল। সবশেষে পরিবেশন করা হয় শাহি দই ও কোক। ভোজনপর্বে বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে তিন হাজারের অধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। অন্য রকম এক আমেজ তৈরি হয়।
ভোজন পর্ব শেষ হতে না হতেই বেলা আড়াইটার পর থেকে শুরু হয় স্মৃতিচারণা পর্ব। প্রথম দিকে ১৯৬৭-৬৮ ব্যাচের কয়েকজন স্মৃতিচারণা করেন। তাঁদের কথা শুনে মনে হয়, তাঁরা যেন সে সময় সেই আগের দিনেই ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁদের বয়ানে উঠে আসে ’৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থান, ’৭০–এর নির্বাচন, ’৭১–এর মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি। পরের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কথায় উঠে আসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথাসহ বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত নানা আলোচিত–সমালোচিত ঘটনা।
প্রতিটি যৌক্তিক আন্দোলনে মুহসীন হলের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল বলে বক্তারা জানান। সাবেক শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণা শুনে বর্তমান শিক্ষার্থীরা অনুপ্রেরণা পান। তাঁরাও মনে মনে পণ করেন সামনের দিনে দেশমাতৃকার উন্নয়নে নিজেকে সঁপে দিবেন। স্মৃতিচারণার ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ নিজেদেরকে ক্যামেরাবন্দী করেন। বেলা পাঁচটার দিকে সাবেক শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান, নাচ ও নৃত্যের তালে মেতে উঠে সবাই। সময় আপন গতিতে ছুটে চলে। একটা সময় সুয্যিমামা পশ্চিম আকাশে লাল রং ধারণ করে জানান দেন, দিন শেষ, রাতের আগমন আসন্ন। তখনো কারও মনে যেন ক্লান্তির বিন্দু পরিমাণ ছাপ নেই। অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। সন্ধ্যা সাতটার পর খানিকটা সময় বিরতিতে চলে। এই সময়ে লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ী ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনকে স্মার্টফোন, বাকী ৩ জনকে ক্রমিক অনুসারে মোটরসাইকেল, রঙিন টেলিভিশন ও এয়ারকুলার উপহার দেওয়া হয়। বিজয়ীরা ক্ষণিক সময়ের জন্য আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। সবশেষে মঞ্চে উঠেন চিরকুট। চিরকুট প্রায় রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গান পরিবেশন করে। এই সময়টায় সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা বয়সের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একসঙ্গে আনন্দ আড্ডায় মেতে ওঠেন। তখন এক অন্য রকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। সেই চিরন্তন নিয়ম মেনেই শেষ হয় সেদিনের সুবর্ণজয়ন্তীর সব আয়োজন।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।