স্মৃতির পাতায় শৈশবের ঈদ

প্রথম আলো ফাইল ছবি

শৈশবকে বলা হয় জীবনের সোনালি অধ্যায়। শৈশবের স্মৃতিগুলো যেন একটু বেশিই রঙিন। শৈশবের দিনগুলো যেমন মধুময়, তেমনি ঈদও আনন্দময়। শৈশবের ঈদের আনন্দ থেকে খুঁজে পাওয়া যায় ঈদের অর্থ। যৌবনের এ ব্যস্ত সময়ে মাঝেমধ্যে হাতছানি দেয় শৈশবের সেই নিখাদ ঈদ-আনন্দ। এবার পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই ভাবছিলাম, সেই সোনালি দিনের ঈদ-আনন্দ নিয়ে লিখব। ভাবতে ভাবতে রোজা শেষ। নানান ব্যস্ততায় লিখে উঠতে পারিনি। বাড়ির উঠানে গাছের ছায়ায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করার সময় হঠাৎই মনে হলো, তবে এখনই লিখে ফেলা যাক শৈশবের ঈদের সেসব রঙিন স্মৃতি।

শৈশবের পুরোটাই কেটেছে গ্রামে। গ্রামের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেত রোজায়। রোজা শুরুর পর থেকেই ভিন্ন এক আমেজ তৈরি হতো। সাহ্‌রি রান্না করার জন্য মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি চলত, বাজানো হতো হামদ-নাত। তবু মাইকের শব্দে কখনো ঘুম ভাঙেনি আমার। আব্বু-আম্মুর কয়েক দফা ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙত। নিয়মিত রোজা না রাখলেও সাহ্‌রি করা ছিল আমার শখ। মাঝেমধ্যে এত ডাকাডাকির পরও উঠতে পারতাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠে অভিমান করতাম সাহ্‌রিতে না ডাকার জন্য।

ইফতারের আনন্দ তো বলে বোঝানোর মতো নয়। গ্রামের সব পুরুষ, শিশু-কিশোর একসঙ্গে ইফতার করত মসজিদে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল মসজিদ, তাই প্রায় নিয়মিত মসজিদে ইফতার করা হতো। সবার সঙ্গে বসে ইফতারের আনন্দ বলে বোঝানোর মতো নয়। গ্রামে ঈদের আমেজ তৈরি হতো ২০ রোজার পর থেকেই। আম্মু সবার কাপড় ধোয়া, ঘরবাড়ির পরিষ্কার করা শুরু করতেন তখন। মাটির ঘরের মেঝেতে হাতের নিপুণ কারুকার্যে দিতেন নতুন মাটির প্রলেপ।

নামাজ শেষে আব্বু আমাকে নিয়ে যেতেন আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে। সেখানে দাদা-দাদির কবর জিয়ারত করে ফিরতাম বাড়িতে। এসেই দেখতাম আম্মু রান্না শুরু করে দিয়েছে।

ঈদের নতুন জামা সবার থেকে লুকিয়ে রাখা ছিল শৈশবের ঈদ-আনন্দের একটি অংশ। ঈদের জামা কেনার পর নিজেই লুকিয়ে রাখতাম। অনেকে নতুন জামা দেখতে চাইলেও কিছুতেই রাজি হতাম না ঈদের আগে নতুন জামা দেখাতে।

ঈদের চাঁদ দেখার মধ্যে ছিল এক অন্য রকম প্রতিযোগিতা। কে সবার আগে চাঁদ দেখবে, তা নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। রোজা ২৯টা হবে না ৩০—এ নিয়ে চলত নানা জল্পনা-কল্পনা। বিশেষ করে শিশুকিশোরদের মধ্যে এই আলোচনা হতো। আমাদের মসজিদের পাশে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, যেখান থেকে চাঁদ দেখা যেত। ২৯ রোজার ইফতারের পর সব বন্ধু মিলে ভোঁ-দৌড় দিতাম ঈদের নতুন চাঁদ দেখার জন্য। সবার আগে চাঁদ দেখে সেই চাঁদ অন্যকে দেখানোর মধ্যে ছিল স্বর্গীয় আনন্দ। মাঝেমধ্যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় ঈদের চাঁদ দেখা যেত না আকাশে। তখন মন খারাপ হতো সবার। তবে চাঁদ দেখা গেলে মসজিদের মাইক থেকে আসত ‘ঈদ মোবারক’ ‘ঈদ মোবারক’ ধ্বনি।

ঈদের নামাজ
ফাইল ছবি

চাঁদরাতে মেহেদি পরার প্রচলন ছিল। বাড়িতে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট। তাই সবার আগে মেহেদি নেওয়ার আবদার করতাম সব সময়। বড় আপুরা আমার আবদার মেনেও নিত। হাতের ত্বকে দেওয়া হতো বাজার থেকে কিনে আনা মেহেদি আর নখে দেওয়া হতো মেহেদিগাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে হাতে প্রস্তুত করা মেহেদি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার হাতের রং পরীক্ষা করা হতো। একজন অন্যজনকে বলত, আমার হাতের রং বেশি গাঢ় হয়েছে। তবে আমার হাতের মেহেদির রং কখনো গাঢ় হতো না। এ নিয়ে অভিমানও কম করিনি।

ঈদের দিন সকালে ফজরের নামাজ পড়া ছিল সে সময়ের গ্রামের ঐতিহ্য। বছরের অন্য কোনো দিন নামাজ না পড়লেও এদিন গ্রামের সবাই নামাজে আসত। মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ হতো। মসজিদের বাইরেও জায়নামাজে অনেকে নামাজ পড়ত। তবে এদিন যেন সব রাজ্যের ঘুম জড়ো হতো আমার চোখে। অনেক প্রস্তুতি থাকার পরও উঠতে পারতাম না ঠিক সময়ে। জামাত শেষ হওয়ার পর উঠে একা একা নামাজ পড়ে আসতাম। ফজরের নামাজ শেষে গ্রামের মাতব্বরের বাড়িতে খিচুড়ি খাওয়ানো হতো। তবে সেখানে গিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। নামাজ শেষে আব্বু আমাকে নিয়ে যেতেন আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে। সেখানে দাদা-দাদির কবর জিয়ারত করে ফিরতাম বাড়িতে। এসেই দেখতাম আম্মু রান্না শুরু করে দিয়েছে।

খিচুড়ি আর সেমাই আমাদের অঞ্চলে ঈদের দিনের সকালের খাবার। ঈদের দিনের সকালের খিচুড়িটা অন্যান্য যেকোনো দিনের খিচুড়ির চেয়ে বেশি মজার হতো।
রান্না হতে হতে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতাম। নতুন জামা পরে প্রস্তুত হয়ে খেতে বসতাম। খাবার সেরে রওনা হতাম ঈদগাহের উদ্দেশে। আমাদের ঈদগাহতে যাওয়ার জন্য কোনো রাস্তা ছিল না। ফসলের জমির আল দিয়ে আমরা যেতাম ঈদগাহে। একসঙ্গে দল বেঁধে ঈদগাহে যেতাম। ঈদগাহে যেতে যেতে একে অন্যের পোশাক দেখা হতো। আলোচনা হতো কে কত টাকা সালামি পেয়েছে। মনে পড়ে, বর্ষার সময় দুবার ঈদ হয়েছিল। তখন চারদিকে অথই পানি। সবাই নৌকায় ঈদগাহে গিয়েছিলাম। সে ছিল এক অন্য রকম অনুভূতি।

ঈদগাহে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়া হতো। ঈদগাহে একপ্রকার মিষ্টান্ন পাওয়া যেত, নাম ছিল দানাদার। আব্বু সব সময় আমাদের দানাদার কিনে দিতেন। তবে এখন আর সেই মিষ্টান্ন সচরাচর দেখি না।

পড়ালেখা না করা ছিল ঈদের দিনে আমার কাছে অন্যতম আনন্দের বিষয়। এদিন বই নিয়ে বসতে হতো না, কেউ পড়ার জন্য কিছু বলত না। সন্ধ্যায় টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখতাম সবাই মিলে। আর আম্মু রান্না করতেন আমার পছন্দের খাবার।
আজ এগুলো কেবলই স্মৃতি। মধুর সেই স্মৃতি মনে পড়ে মাঝেমধ্যে। আর খুঁজে ফিরি ঈদের সেই স্বর্গীয় আনন্দ। আর সায়ানের গানকে একটু ঘুরিয়ে বলতে ইচ্ছা হয় ‘কেন বাড়লে বয়স ছোট্টবেলার আনন্দ (বন্ধু) হারিয়ে যায়।’

*লেখক: এস এম তাওহীদ, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]