জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, নবীনদের যা প্রত্যাশা
১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী মানে পুরোনো জীর্ণতাকে মুছে ফেলে নতুনত্বের সূচনা ঘটানো। ফেলে আসা একটি বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার সম্মিলিত প্রয়াসে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরুর শপথ নেওয়ার দিন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার পাশাপাশি রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক হওয়া সত্ত্বেও তীব্র সিটসংকট চলছে হলগুলোতে। এ ছাড়া সেশনজট, ক্লাসরুমের সংকট, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, সংকটাপূর্ণ চিকিৎসাকেন্দ্র তো রয়েছেই। সময়োপযোগী অনেক বিভাগ এখনো চালু হয়নি। তা ছাড়া প্রায়ই দেখা যায় রাজনৈতিক দলাদলি আর হানাহানি। এ ধরনের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশে তার দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। জ্ঞানের শিখা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্ব ভূমণ্ডলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। যে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পেতে যাচ্ছে স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিত উন্নত এবং সমৃদ্ধ এক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি থাকে নবীন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে তাই নবীন শিক্ষার্থীদের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নতুন উদ্যমে পথ চলার যে এটাই সঠিক সময়। অথচ ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও ক্যাম্পাসে আসার অনুমতি পায়নি নবীন শিক্ষার্থীরা। তাই নবীনদের ছাড়াই পালিত হচ্ছে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
বলছি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কথা। যাঁরা ক্যাম্পাসে ৫২ ব্যাচ হিসেবে পরিচিত। ভর্তির কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও ক্যাম্পাসে আসার অনুমতি পায়নি এই তারুণ্যের দল। আবাসনসংকট থাকায় বাড়িতে বসেই অনলাইনে ক্লাস করে কাটছে সময় তাঁদের। পাশাপাশি চলছে তাঁদের সমস্যাজর্জর অনলাইন পড়াশোনা। প্রাণবন্ত ক্যাম্পাসের অপরূপ সৌন্দর্যের প্রকৃতিকে আপন করে পাওয়ার যে ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা তাঁরা মনের মধ্যে পোষণ করেছিলেন, তাঁদের সেই ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষায় যেন ভাটা পড়েছে।
শিক্ষাজীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে। যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনা হয় অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের মধ্যে দিয়ে। শত শত স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে, নিজেকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে আসে হাজারো উচ্চশিক্ষা–পিপাসু তরুণ-তরুণী। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার তাগিদে জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের হাঁসিঠাট্টা আর গল্প–আড্ডায় মাতিয়ে তোলার কাঙ্ক্ষিত সময় হলো অনার্স প্রথম বর্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্পর্কে জানার, বোঝার, বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে মজবুত করার সময় হলো অনার্স প্রথম বর্ষের সময়টুকু।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কিছু নবীন শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ধরা হলো:
অনেক ভালোবাসি প্রাণের ক্যাম্পাসকে
একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সিয়াম আহমেদ বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি নাম নয়, আমার আবেগ ও ভালোবাসার অনন্য প্রতীক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বন্ধন, তা এককথায় অতুলনীয় এবং এই বন্ধন শিক্ষাজীবন শেষে কর্মক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বরাবরই দেশ সেরা আমার বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে (৫২ ব্যাচ) আমরা এখনো সশরীর ক্লাস করতে পারছি না। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। তবে আশা করি, খুব দ্রুতই সব সমস্যা কাটিয়ে আমরা অফলাইনে ক্লাস করতে পারব। নতুন বছরে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ি দেবে বহুদূর।’
আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হোক
ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ের শিক্ষার্থী আয়শা আক্তার বলেন, ‘টাইমস হায়ার এডুকেশনের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে ৮০১তম স্থান অর্জন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যা আমাদের জন্য অন্ত্যন্ত গর্বের বিষয়। তবে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের নবীন (৫২ ব্যাচ) শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার ৫ মাস পর ৩০ নভেম্বর অনলাইন ক্লাস শুরু করা হলেও এখন পর্যন্ত অফলাইন ক্লাসের কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ জানায়নি প্রশাসন। অনলাইনে শিক্ষকেরা গুরুত্বের সঙ্গে সুন্দরভাবে ক্লাস নিলেও ঢাকার বাহিরের অনেকেরই বই সংগ্রহে করতে পারছে না এবং নেটওয়ার্ক সমস্যার মতো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা। পৃথিবী যখন গ্লোবাল কম্পিটিশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমরা তখন নিজেদের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেটদের থেকেই পিছিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে আমাদের অফলাইন ক্লাসের সুনির্দিষ্ট তারিখ না দিয়েই প্রশাসনের ৫৩ ব্যাচের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করার মতো সিদ্ধান্ত আমাদের প্রতি অবহেলামূলক আচরণ নির্দেশ করে, যা আমাদের সত্যিই অনেক বেশি হতাশ করে।’
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জাতির মননের প্রতীক
আমানউল্লাহ খান পড়েন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগে। তিনি বলেন, ‘শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, মনুষ্যত্ববোধ অর্জনের সোপানসমূহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য মানবাধিকারের মতো উন্মুক্ত করে দিয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্যে “স্থান-কাল-পাত্র”–এর যে মৌলিকত্ব রয়েছে, তা পূরণ করছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষ জনশক্তি অর্জনে শিক্ষা ও গবেষণার জন্যে মুক্ত জ্ঞানচর্চার যে আবশ্যকতা, তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। যৌবনের উত্তাল সময়ে বর্ণিল জীবনের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিভাবানরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত অবস্থায় কেউ তাঁর স্বপ্নকে আরও রঙিন করেন আবার উপর্যুক্ত পরিবেশের অভাবে কেউ-বা তাঁর স্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়েন। উচ্চশিক্ষা শেষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সফলতার গল্প বা হতাশার অধ্যায় বহিঃপ্রকাশ হয়।’
নতুন বর্ষে নতুন উদ্যমে জ্বলে উঠুক প্রিয় ক্যাম্পাস
পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আনিকা নাওয়ার মুগ্ধ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় দুয়ারে, ঐতিহ্যের নব উত্থানে ছড়িয়ে পড়ুক রং মোদের জয়োল্লাসে। প্রতিষ্ঠা–পরবর্তী সময় থেকেই উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতি চর্চার এক অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবিরত অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সৌন্দর্য মনে করিয়ে দেয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্ব ও সাহসের ইতিহাস। জাহাঙ্গীরনগর নামটি আমাকে দিয়েছে একটি অমায়িক ঠিকানা। সামনের দিনে আরও সমৃদ্ধ হোক তাঁর এই পথচলা। নতুন বর্ষে নতুন উদ্যমে আবার ফুল ফুটুক, আবার ইতিহাস হোক, উদ্যাপনের ঝড় চলুক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দুয়ারে।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে থাকতে না পারার আক্ষেপ
আইন ও বিচার বিভাগের রাতুল ইসলাম ফারদিন বলেন, ‘আমি গর্ববোধ করি, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পেরে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বর্ণিল আলোকচ্ছটায় সেজে উঠল স্বপ্নের ক্যাম্পাস—কিন্তু অনলাইনে ক্লাস করতে থাকা আমরা তা উপভোগ করতে পারলাম না। এটা একটা মনের মধ্যে থাকা আক্ষেপ। তবু জন্মদিনে চাওয়া জাবিতে যেন শিক্ষার্থীরা তাঁদের প্রতিভার সর্বোচ্চ উন্মেষ ঘটাতে পারে।’
প্রিয় ক্যাম্পাসে ফেরার অপেক্ষায় আছি!
ইংরেজি বিভাগের অরূপা রহমান বলেন, ‘মুক্তচর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণা এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখানোর মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৫২তম আবর্তনের শিক্ষার্থীরা আজ প্রশাসনের গাফিলতি, হল বরাদ্দের ক্ষেত্রে অসচেতনতাসহ আরও কিছু কারণে ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকতে না পারার দরুন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনে অংশগ্রহণ করতে পারলাম না। তবে নিজেকে জাবিয়ান হিসেবে ভাবতে পেরে গর্ববোধ করছি। সর্বশেষ বলতে চাই, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উজ্জীবিত হোক প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়।’
সুখ-সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যাক প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ফারিহা জান্নাতি বলেন, ‘প্রকৃতি আর মানুষের সংমিশ্রণে স্রষ্টার তৈরি এক অপূর্ব ভূমি হলো আমাদের ক্যাম্পাস। প্রজাপতির বাগান, জলপদ্মের লেক, অতিথি পাখি, বিভিন্ন রকমের গাছপালার ছায়ায় বছরের পর বছর পাঠ কার্যক্রম শেষ করে নিজেকে সফল করার চেষ্টায় নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসন্তানেরা। আবেগ আর ভালোবাসার নাম আমার প্রাণের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।’
ক্যাম্পাসে গিয়ে সশরীর ক্লাস করতে চাই
ইতিহাস বিভাগে পড়ুয়া খুশনূর বিনতে খাইরুল বলেন, ‘সাংস্কৃতিক নানা বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হবে অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন ব্যাচ হয়েও অংশ নিতে পারব না, হলে উঠতে পারছি না, ক্লাস করতে হচ্ছে বাড়িতে বসে। এটি সত্যিই একটি আক্ষেপের বিষয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আরও বেশি উজ্জীবিত হোক প্রাণের প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষা-সহায়ক কার্যক্রম এবং নিজ গুণাবলিতে দেশ-বিদেশে দিনকে দিন আরও অনন্য হয়ে উঠুক আমাদের প্রাণের জানবিবি।’
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]