স্মৃতির পাতায় পয়লা বৈশাখ

ফাইল ছবি প্রথম আলো

আমার কাছে পয়লা বৈশাখ মানে একটা আত্মিক উৎসব, যা আমার হৃদয়ের একদম কাছাকাছি অবস্থান করে। ব্যক্তিগত নানা বাস্তবতায় বছর তিনেক ধরে উদ্‌যাপনে চূড়ান্ত ভাটা পড়ে গেলেও অনুভবের দিক থেকে উৎসবটির আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি আমার মাঝে। শৈশবে ঈদ ছাড়া পয়লা বৈশাখই ছিল একমাত্র উৎসব, যা আমার মহল্লায় মহাসমারোহে পালিত হতো। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, কালের বিবর্তনে তার ছিটেফোঁটাই কেবল অবশিষ্ট রয়েছে এখন।

ছোটবেলায় আমার পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল সকালে গোসল সেরে নতুন ফতুয়া অথবা পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে বাইরে বেরোনো। বাসা একেবারে বাজারের কেন্দ্রে পড়ায় উৎসব ও উদ্‌যাপনের নানা রকমফেরের সঙ্গে পরিচিত হয়েই বেড়ে ওঠা আমার। আমাদের ঘোড়াশালে পয়লা বৈশাখ পালন করা হতো দুটি ভিন্ন দিনে। কেউ কেউ ১৪ এপ্রিল নতুন বছরকে বরণ করে নিতেন, কেউ–বা পঞ্জিকামতে নতুন বছরকে বরণ করতেন ১৫ এপ্রিল।

একদম ছেলেবেলা থেকে একটা লম্বা সময় পর্যন্ত আমার নতুন বছর শুরু হতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাওয়া-খাওয়া সেরে বৈশাখের নতুন ফতুয়া নয়তো পাঞ্জাবি পরে বাইরে টইটই করে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে। এ সময় পরিচিত দোকানদারেরা ডেকে মিষ্টিমুখ করাতেন। কেউ খাওয়াতেন বাতাসা, কেউ–বা কদমা, এমনকি কেউ কেউ দুধ নয়তো মাঠাও খাওয়াতেন। বর্ষবরণের দিন এ রীতিগুলোর চল ছিল আমাদের ওখানটায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

তারপর তপ্ত রোদে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেই শুরু করতাম কনসার্ট দেখা। অনেককাল ধরেই এনটিভিতে প্রতি পয়লা বৈশাখে ‘রুচি বৈশাখী উৎসব’ নামে একটা কনসার্ট সরাসরি সম্প্রচার করা হতো পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ মাঠ থেকে। করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেলে কনসার্টটি পরে আর আয়োজন করা হয়নি।

তা ছাড়া দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই দেখতে বসে যেতাম আরও একটা কনসার্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর থেকে সে কনসার্টটা সরাসরি সম্প্রচার করত বাংলাভিশন। প্রতিবারই ওই কনসার্টের মূল আকর্ষণে থাকতেন জেমস ভাই। ২০১৯ সালে আগের রাতে মঞ্চ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং পরে করোনা ও রোজার কারণে এ আয়োজনটা এখন একেবারেই হারিয়ে গেছে।

মোটামুটি শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণের আগপর্যন্ত পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে এসবই ছিল আমার নিয়মিত কাজ। কৈশোরে গিয়ে অবশ্য তাতে কিছুটা পরিবর্তন আসে। তখন ফতুয়া কিংবা পাঞ্জাবি পরে দিন শুরু করা হলেও সূর্যের তাপ মাথায় নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ানোটা আর হতো না। তবে কনসার্ট দুটো কিছুতেই মিস হতো না। মিস হয়নি এগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্তও।

এবার একটু ভোজনের কথায় আসি। জাতি হিসেবে বাঙালি সব সময়ই ভোজনরসিক। তাই আমাদের নিয়মিত খাদ্যতালিকায় প্রচুর বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। আর সেটা যদি হয় কোনো উৎসব-পার্বণে, তাহলে তো কথাই নেই! আমার বাসায় বরাবরই পয়লা বৈশাখের সকালটা শুরু হতো গরম ভাত, আলু ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা ও ভুনা, কড়কড়ে ইলিশ ভাজা ও আমডাল দিয়ে। দুপুরের তালিকায় থাকত ভুনা খিচুড়ি, গরুর গোশত ও ইলিশ ভুনা। পয়লা বৈশাখের বিশেষ ভোজনে এটাই সব সময় অনুসরণ করতে দেখে এসেছি মাকে, যত দিন পর্যন্ত না রোজার সঙ্গে উৎসবটির সময়জনিত সংঘর্ষ ঘটে।

বৈশাখের মূল আকর্ষণ ছিল বৈশাখী মেলা। আমার পাড়ায় মেলা হতো প্রতি বৈশাখ মাসের তৃতীয় দিন। শৈশবে এই মেলা মানেই ছিল খেলনা মোবাইল ও গিটার কেনা, কৈশোরে চটপটি-জিলাপি খাওয়া এবং পরবর্তী সময়েও তা-ই। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণে আমাদের বৈশাখী মেলা সর্বদা মুখরিত থাকত। মেলাটা বসত রাস্তার দুই ধারে একটা লম্বা জায়গাজুড়ে। মেলার দিন সে রাস্তায় গাড়ির বদলে মানুষেরই জটলা লেগে যেত। যদিও বৈশাখী মেলায় মানুষের ভিড়, ভিড়ে ধাক্কা খাওয়া, পেছন থেকে কারও পায়ে আটকে স্যান্ডেল ছেঁড়ার ঘটনাগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মেলাটা যে বর্তমানে অস্তিত্বই হারিয়ে বসে আছে আমাদের অঞ্চলটায়!

আসলে চিন্তা করলে দেখা যায়, এখন আমাদের এলাকায় পয়লা বৈশাখের তেমন কোনো অস্তিত্বই নেই। আগের সেই উৎসবমুখরতা তো নেই-ই, হারিয়ে গেছে সেই রীতিনীতিগুলোও। আগে পয়লা বৈশাখের দিন ঢোল পিটিয়ে বাজার থেকে টাকা তুলত তৃতীয় লিঙ্গের একটা দল। বেশ কয়েক বছর হলো তাদের ঢোলের শব্দ আর শুনতে পাই না। সেই সঙ্গে এই দিনে পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের গায়ে বৈশাখী জামা চোখে পড়ত। এখন এমনটা দেখা তো দূরের কথা, বাজারে কাপড়ের দোকানে পয়লা বৈশাখের কোনো পোশাক পাওয়াই যেন দুষ্কর!

ভাটার কবল থেকে রক্ষা পায়নি বাংলার চিরাচরিত হালখাতার রীতিটিও। আগে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহজুড়ে দোকানে দোকানে হালখাতার হিড়িক পড়ে যেত৷ এখান থেকে ওখান থেকে বাসায় মিষ্টি-নিমকি আসত। এমনকি মাসিক বাকি খাওয়ার দোকান থেকে মিষ্টির সঙ্গে বিরিয়ানির প্যাকেটও দেওয়া হতো। এখন এই হালখাতা সংস্কৃতিরও বেহাল আমাদের এখানে৷ বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি দোকানেই শুধু তা পালন করা হয়।

এদিকে পরিবারে চিকিৎসক পেশাজীবী থাকায় নতুন বছরের প্রাক্কালে বিভিন্ন উপহার মিলত ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। সেগুলোর মধ্যে খেলনা একতারা, বাঁদর নাচানোর বাদ্যযন্ত্র, মুড়িমুড়কি-সন্দেশ-নাড়ুসহ আরও অনেক খাদ্যসামগ্রী ভর্তি বাঁশের বাক্স ও পাতি উল্লেখযোগ্য। কালক্রমে এসব উপহারেরও দেখে মেলে না অনেক বছর যাবৎ।

সব মিলিয়ে আমার জীবনে পয়লা বৈশাখ ঠিক আগের মতো নেই। শুধু খাওয়াদাওয়া ও অনুভবের মাঝেই উৎসবটির উদ্‌যাপন সীমাবদ্ধ। এর পেছনে নিজের দায় তো কিছু রয়েছেই, পারিপার্শ্বিকের দায়টাও বোধ হয় কম নয়।

সবাইকে শুভ নববর্ষ!

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]