বিসিএস উন্মাদনা ও আমরা

ছবি: চাকরি–বাকরি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার এক জরিপে দেখা যায় দেশে ৬৬ শতাংশ শিক্ষিত বেকার। এ ছাড়া লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট-এর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে অনেকে সফল হওয়া বলতে শুধু বিসিএস ক্যাডার হওয়াকে বোঝেন।

দিন দিন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম উন্মাদের মতো বিসিএসের দিকে দৌড়াচ্ছে। বিসিএস উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ৪০তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা মালদ্বীপের জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিসিএস নামক এই সোনার হরিণের পিছে ছুটে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ দেশের জনশক্তিতে কাজে লাগতে পারছে না।
সর্বশেষ কয়েকটি বিসিএসে দেখা গেছে, গড়ে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ প্রার্থী বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন। বিসিএসের সব ক্যাডার মিলিয়ে গড় সাফল্যের হার ০.৫ শতাংশ। যদিও প্রতিবছর এই হার পরিবর্তন হয়। বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। এই বিসিএস আবেদন থেকে শুরু করে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষ করে চূড়ান্ত ফলাফল পর্যন্ত ৩-৪ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বিসিএস নামক এই মরীচিকার পেছনে ছুটছে। প্রতিবছর গড় মাত্র আড়াই হাজার পদের জন্য প্রায় ৪ লাখ আবেদনকারী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মানে হচ্ছে বিসিএসে অংশগ্রহণকারী ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ বেকার জীবন যাপন করছে।
বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রথম টার্গেট থাকে বিসিএস। এমনিতেই দেশের উচ্চশিক্ষায় দক্ষতাভিত্তিক পড়াশোনা নেই বললেই চলে। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোতে স্নাতকপড়ুয়া অসংখ্য শিক্ষার্থী তাঁদের পড়াশোনার মূল বিষয় বাদ দিয়ে বিসিএসের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে তাঁদের মূল বইয়ের চেয়ে বিসিএস প্রস্তুতির বই বেশি দেখা যায়।

একজন শিক্ষার্থী তাঁর ছাত্রজীবনে প্রায় ২ থেকে ৩ বছর বিসিএস প্রস্তুতি নেন। এরপর পড়াশোনা শেষ করে অনেকে আরও প্রায় ৩ বছর শুধু বিসিএস প্রস্তুতি নেন। এরপর বিসিএসে কোনো কোনো ধাপে ভালো করলে তখন আবার ফলাফলের জন্য এবং নিয়োগের জন্য আরও ২ থেকে ৩ বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা এই বিসিএসের জন্য সর্বনিম্ন ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছরের মতো সময় নেন। এখানেই শেষ নয়, হয়নি বিসিএসের আত্মকাহিনি। অন্তত চার থেকে পাঁচবার বিসিএস দিয়েও যখন টিকতে পারছেন না, তত দিনে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বয়স প্রায় ৩০ বছর পার হয়ে যায়। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০। তাই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দাবি জানাচ্ছেন, এই বয়সকে আরও ৫ বছর বাড়িয়ে সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার জন্য।

মানে জীবনের মূল্যবান সময়ের আরও পাঁচটা বছর এই মরীচিকার পেছনে ব্যয় করা হোক। অদম্য মনোবল ভালো কিন্তু অপরিণামদর্শিতা ভালো নয়। চাকরির বয়স বাড়ানো হলেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশসংখ্যা তো বাড়ছে না। ২০০০ হাজার পদের বিপরীতে ৪ লাখ মানুষ প্রতিযোগিতা করলে অধিকাংশ মানুষই চাকরিটা পাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তবুও দিন দিন এই প্রতিযোগিতা বেড়েই চলছে। এমনকি আমার দেশের বিসিএস আবেদনকারীর সংখ্যা বেশ কিছু দেশের মোট জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়। বিসিএসের সব ধাপ সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করার পরও শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরি হয়নি এমন নজিরও বহু আছে। এমনকি উপযুক্ত নির্দেশনা ও পরিকল্পিত পড়াশোনার অভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন প্রস্তুতি নেওয়ার পরও সাফল্যের মুখ দেখতে পান না।

বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য ও সফলতার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিসিএস ক্যাডার হওয়া’! সমাজের প্রায় প্রত্যেক অভিভাবকের ইচ্ছা—তাঁর সন্তান একজন বিসিএস ক্যাডার হোক। অন্যদিকে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতায় একজন শিক্ষার্থীর মধ্যেও এমন বোধ জাগ্রত হয়—যেন বিসিএস ক্যাডার হতে পারাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য! কী অদ্ভুত প্রবণতা! বুয়েট, কুয়েটে পড়ে বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার উদাহরণ আমাদের দেশে অনেক। এ থেকে খুব স্পষ্টই বোঝা যায়, সমাজে বিসিএস উন্মাদনা কতটা প্রকট। শিক্ষা মানুষের জীবনযাপনের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি হলেও আমরা শিক্ষার সার্থকতা মূল্যায়ন করি শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে। কিন্তু এ শিক্ষা একজন সুন্দর মানুষ হতে কিংবা সুন্দর জীবনযাপনে কতটুকু ফলপ্রসূ, তা থেকে যায় আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে! ফি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, সবার লক্ষ্য যেন একটাই, বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এই সংস্কৃতি দিন দিন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে—এই কথা বলা বাহুল্য। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, চাকরিপ্রার্থীরা প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষিত। সবারই রয়েছে নতুন কিছু সৃষ্টির যোগ্যতা। কিন্তু তাঁদের মধ্যে সেই সৃষ্টির ক্ষুধা তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে ব্যর্থ। এমনকি আমাদের সমাজ সৃজনশীল ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতেও যেন প্রস্তুত নয়। সাংঘাতিক পরিতাপের বিষয়! মূলত এ কারণেই আমাদের যুবসমাজ বিসিএসের গৎবাঁধা মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়।

এ সমাজে বিসিএস ক্যাডারদের সবচেয়ে মেধাবী ও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য সৃজনশীল কিংবা সৃষ্টিশীল হওয়ার বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়ে না। মুখস্থবিদ্যাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলেই কেল্লা ফতে—বিসিএস ক্যাডার হওয়ার রাস্তা ফাঁকা! শিক্ষানীতি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান সঞ্চারণ, নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন এবং সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত খুব কমসংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা সৃজনশীল অর্থাৎ নতুন জ্ঞান উদ্ভাবনে আগ্রহী।

উচ্চশিক্ষা মুক্তমনা অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিকাশে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রেও আমরা ক্রমাগত পেছনের দিকে হেঁটে চলেছি। বাস্তবতা হলো শিক্ষাব্যবস্থা নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মুক্তচিন্তা কিংবা নিজেকে সৃষ্টিশীলতার দিকে ধাবিত করার অনুকূলে নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশও। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেন বলেও মনে হয় না।

একবিংশ শতাব্দীর এই প্রতিযোগিতার বিশ্বে টিকে থাকতে বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল, দূরদর্শী, অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক জাতি গঠনের বিকল্প নেই। এ জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। দেশে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে গেড়ে বসা মুখস্থনির্ভরতার সংস্কৃতির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়কেও গুরুত্বসহকারে আমলে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেন প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পান। গৎবাঁধা মুখস্থবিদ্যার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীলতা, গবেষণা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে চাকরির বাজারে। কেবল এর মধ্য দিয়েই উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে।

*লেখক: মিজানুর রহমান মিজান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ