বাবার ডায়েরি

লেখার মাধ্যমে কখনো কোনো ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা যায় না। যাকে নিয়ে এই লেখা, তিনি আমার বাবা মরহুম খোন্দকার তোজাম্মেল হক। তিনি দীর্ঘদিন সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত নিমগাছি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৩৯ বছরের ঘটনাবহুল তাঁর কর্মজীবন। ১৯৪১ সালে জন্মাবার কারণে তিনি ব্রিটিশ, পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ শাসনামল অতিবাহিত করেছেন। চাকরিবিধি অনুসারে তিনি ২০০১ সালে নিয়মিত কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। তাঁর কর্মজীবন ছিল নানা প্রতিকূলতায় ভরা, বর্ণিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেই কর্মময় জীবনকে একটি লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা কোনো সহজ বিষয় নয়।

আমার বাবা ছিলেন শিক্ষক। একেবারে শুরু (ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর) থেকেই শিক্ষক। অন্য কোনো পেশায় যাননি; যাবার কথা কখনো ভেবেছেন বলেও মনে হয় না। এলাকায় ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি ক্লাসে ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন। শিক্ষানুরাগী সমাজ সচেতন মানুষটি দৈনন্দিন কাজসহ সবকিছু রুটিন অনুযায়ী করতেন। সময় সম্পর্কে তিনি অতি সচেতন ছিলেন। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখিনি। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ, নৈতিক দৃঢ়তা ছিল তাঁর জীবনের অনন্য দিক। তিনি কোনো দিন স্বেচ্ছায় দেরি করে কোনো আচার-অনুষ্ঠানে যাননি। পেশাগত জীবনে তিনি একনিষ্ঠ, সুদক্ষ ও অধিক মনোযোগী ছিলেন। শিক্ষাদানই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান ব্রত। কর্মস্থলের বাইরে তিনি নিজ বাড়িতে স্থান সংকুলান না থাকায় পাশের বাড়ির কাচারি ঘরে শিক্ষার্থী রেখে স্বেচ্ছায় ও বিনা বেতনে তাদের জ্ঞানদান করতেন। এ কাজেই ছিল তার আনন্দ। পারিবারিক জীবন তাঁর এই কাজকে ব্যাহত করতে পারিনি।

বাবা কোনো বিষয়ে কিছু বললে তার কোনো নড়চড় হতো না। নিরহংকার ও বিনয়ী প্রকৃতির মানুষটি সব পেশা-শ্রেণির মানুষকেই সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতেন। তবে শিক্ষকগণকে বিশেষ করে তাঁর শিক্ষকদের অধিক সম্মান করতেন। নরম প্রকৃতি ও মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার কারণে নিকট আত্মীয় ছাড়াও গ্রামের অনেকে তার কাছে আর্থিক ও মানসিক সহায়তা চাইলে তিনি না করতে পারতেন না। তবে তিনি ধার দেওয়া অর্থ ফেরতের প্রত্যাশা কোনো দিন করেননি। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে এই সুবিধা নিতেন, যার প্রভাব পড়ত আমাদের ওপর। আমরা পাঁচ ভাইবোন অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছি। স্কুল জীবনে নতুন বই কিংবা খাতা আমাদের কপালে কখনো জোটেনি। ২০০১ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি নামাজ–রোজাসহ নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন এবং লব্ধ জ্ঞান পরিবারের সদস্য ও পাড়া–প্রতিবেশীদের সঙ্গে শেয়ার করতেন। পাশাপাশি তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

অসম্ভব ধৈর্যশীল ও চাপা স্বভাবের এই মানুষটি সর্বদা ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতেন। সন্তানদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা, কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ছিল খুবই সামান্য। তিনি সব শ্রেণির মানুষকে ভালবাসতেন, তবে শিক্ষিত মানুষকে বেশি পছন্দ করতেন। দিনের প্রায় পুরোটা সময় তিনি কর্মস্থলে কাটাতেন। পারিবারিক বিষয়ে খোঁজ খবর রাখার সুযোগ তাঁর জীবনে খুব কমই ঘটেছে। আমার অনেক কষ্ট করে আমাদের সংসার পরিচালনা করতেন। বাবা বাড়িতে অধিকাংশ সময় রেডিও শুনে, টিভি দেখে, বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়ে এবং লেখালেখি করে কাটাতেন। তাঁর আগ্রহ বিষয়গুলোর মধ্যে ইতিহাস ও রাজনীতি অন্যতম।

Simple living and high thinking—কথাটি আমার বাবার ক্ষেত্রে যথার্থ। বাবা খুব সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি সাদা রঙের শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট ও বাটার স্যান্ডাক স্যান্ডেল পরে স্কুলে যেতেন। ছোট চেকের হালকা রংয়ের লুঙ্গি ও সাদা টেট্রন (৩৫/৬৫) কাপড়ের হাফ বা ফুল শার্ট ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক। রঙিন ও গাঢ় রঙের কাপড় তিনি অপছন্দ করতেন এবং আমাদেরও তা পড়তে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি সব সময় নিজেকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতেন। নিজের পোশাক পরিচ্ছদ নিজের হাতেই ধৌত করতেন। নীল ও ইস্ত্রি ছাড়া পোশাক কোনো দিন পরতে দেখিনি।

আব্বা অত্যন্ত গোছানো মানুষ। অফিস ও বাড়িতে নিজের ঘর সব সময় নিজেই পরিপাটি রাখতেন। তাঁর রক্ষিত কোনো জিনিসপত্রে কেউ হাত দিলে খুব বিরক্ত হতেন। মিতব্যয়িতা ছিল তাঁর জীবনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি কখনো কারও কাছ থেকে ধার বা ঋণ গ্রহণ করতেন না। তিনি সব সময় বলতেন, ‘না খেয়ে থাকব, তবুও ঋণ বা ধার করে চলব না।’ বাহুল্য তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। নতুন কোনো পোশাক উপহার দিলে তিনি সহজে তা পরতে চাইতেন না। বলতেন, ‘আমার তো অনেক পোশাক আছে, আবার এতো কিছু কেনার কি দরকার ছিল।’ অধিকাংশ সময় তিনি পুরাতন নরম কাপড় পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। শীতের কাপড়ের মধ্যে কাশ্মীরি শাল ও সুয়েটার তাঁর খুব পছন্দ ছিল। শীতকালে বাটা কোম্পানির কাপড়ের জুতা, বর্ষাকালে নায়েগ্রা জুতা ছাড়া সারা বছরই স্যান্ডেল ব্যবহার করতেন।

বাবা নিমগাছি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হাজি আহম্মদ আলী সরকারের অত্যন্ত স্নেহের তথা একজন প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিদ্যালয়ের সব উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতা করেছেন। স্কুলের প্রয়োজনে নিজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অর্থ ও ধান সংগ্রহের কাজে হাজি সাহেবকে সাহায্য করতেন। বিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর দীর্ঘ পথচলা। অর্থাৎ বিদ্যালয়ে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা ২১ বছর তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়কালে তিনি বিদ্যালয়ের নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সক্ষম হন। ঐ সময়েই বিদ্যালয়টি সরকারি সাধারণ উন্নয়ন পরিকল্পনাভুক্ত হয়ে দোতলা ভবন নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, আসবাবপত্র, পাঠাগারের বই ক্রয় এবং খেলার মাঠের প্রভূত উন্নয়ন হয়। তা ছাড়া সরকারিভাবে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুর হয়। তিনি বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির এবং স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে উক্ত টাকা যথাযথভাবে ব্যয় করেন।

সমাজের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা তিনি লিখে রাখতেন, এটা আমরা অনেকেই জানতাম। তবে তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় যে তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। কিন্তু কাউকে সেটা দেখাতেন না। সযত্নে আগলে রাখতেন। সেই ডায়েরিতে সমকালীন নানা ঘটনা ও বিষয়, কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতা, পরিচিতজন তাঁর সন্তানসন্ততি নিয়ে স্মৃতিকথা লিখে রাখতেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনাসহ আশেপাশের মানুষের উপকারে লাগে এমন অনেক তথ্যও লিখে রাখতেন। পরে আমরা পারিবারিকভাবে এই ডায়েরিগুলো সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিই। বিষয়টি আমাদের জন্য তো বটেই, সমাজের জন্যও জরুরি। সম্প্রতি তাঁর পরিবারের উদ্যোগে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। সে গ্রন্থে তার পরিবারের সকল সদস্যের তার কিছু প্রিয় কিছু শিক্ষার্থী লেখার মাধ্যমে তাদের অনুভূতি জানিয়েছেন। বাবার ডায়েরি পড়ে এখনো অনেক কিছু শিখি, আবেগে আপ্লুত হই।

লেখক: সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধসুদন কলেজ, যশোর