মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
বর্ষাকাল। তীব্র তাপপ্রবাহে যখন নগরজীবন অতিষ্ঠ, ঠিক সে সময়ই তৃষার্ত তরুলতার আর্তনাদ উপেক্ষা করতে না পেরেই দহন মিটিয়ে মেঘমালার রোদন সম্পন্ন হলো। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক বিভাজনের রাজনীতিতে পক্ষপাত করে সারা রাত ধরেই চলল তাণ্ডব। বৈশাখের বৃষ্টি বলে কথা, ধরেই নিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চয়নকৃত উপমার মতো কয় দিনের অক্লান্ত সৈনিকের মতো মুষলধারে থেকে যাবে বারিধারা। বৃষ্টিতে গ্রামীণ জনপদের মেঠো উঠান চিড়ে বাতাসে ভর করে আসছে সোঁদা ঘ্রাণ। পাতলা চাদরের ওমে মুড়েই পাড়ি দেওয়া গেল এক নিদ্রাতুর নিশি।
ভোর গড়িয়ে সকাল হতেই থেমে গেল বৃষ্টি। প্রকৃতি স্নিগ্ধতার মায়ায় জুড়ে আছে। মুঠোফোনে সুহৃদের ‘সুপ্রভাত’ বার্তা স্মরণ করিয়ে দিল, যেতে হবে ক্যাম্পাসে। মানব বসবাসের অনুপযুক্ত নগরের ঠিক শেষ প্রান্তে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই মাটি ও মানুষের মিশেলের এক গ্রাম। সে গ্রামেই বুক চিতিয়ে ৩২ একরে দাঁড়িয়ে আছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়। অঙ্গনে পৌঁছেই সুন্দর সকালে শেষ হলো সংবিধান ও যৎসামান্য রাজনৈতিক আলোচনাও বটে।
ক্লাস শেষে দলবদ্ধতার আড়ালে কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। সুউচ্চ ইমারত থেকে যত দূর চোখ যায়, সবুজ। গাঢ় সবুজ আর মাঝে এঁকেবেঁকে চলেছে নদীর শাখা। যেন কল্পনার একফালি সুখের উঠান।
হঠাৎ বোধ হলো, দূর থেকে ভেসে আসছে সুমধুর এক সুর। মায়া জড়ানো তৃষার্ত সে সুর বারবার ডেকে চলেছে ‘আয়! আয়!’। বিরুদ্ধতার পাশ কাটিয়ে ছুটে গেলাম ৩২ একরের গালিচায়। ব্যাডমিন্টন কোর্ট পেরিয়ে ছায়াবৃক্ষের মোড় পেরুতেই চোখে বিঁধল জটলা। বাদামতলায় বেঞ্চে বসে মনের সুখে চোখ বুজে দোতারা বাজাচ্ছেন একজন শিক্ষার্থী। পাশেই বায়া বাজিয়ে দোতারার সুর আরও মোহনীয় করে সুমধুর কণ্ঠে গান গেয়ে চলেছেন ঝাঁকড়া চুলের যুবক। বকুলতলা পেরিয়ে মুখোমুখি হতেই আন্দাজ মিলে গেল, আরে! এ তো আমাদের মৃদুল। মৃদুলের সুর তখন লৌকিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে স্বপ্নের বুনন শুরু করেছে। মলিন প্রকৃতি ভেদ করে গগনবিদারী কান্নায় বেজে উঠছে ‘জাত গেল জাত গেল বলে’। সত্যিই তো! জাত আবার কী? উপস্থিত প্রত্যেক মুখাবয়ব স্পষ্টভাবেই জানান দিচ্ছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রনির্বিশেষে সবাই আমরা এক, মানবসত্তা। পরম সত্তার সঙ্গেই মিশেছি যেখানে, সেখান এই বন্ধনী কিসের!
পাশে দাঁড়ানো আইনের এক ছাত্র বললেন, বিভাজনের রাজনীতির চূড়ান্ত রূপ হলো, মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া। শব্দের পায়ে বেড়ি দেওয়া। প্রসিদ্ধ লালনের গানের উচ্চারণেও নাকি নিশীথের জুজুর ভয়!
সেসব ভাবতে ভাবতেই আরেক গানে ফিরে গেল উৎফুল্ল শিক্ষার্থীরা। এবার সুর বেঁধেছে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। খেয়াল করলাম, একাডেমিক বিল্ডিং থেকে ক্লাসের তোয়াক্কা না করেই জানালায় জড়ো হয়ে মৃদুলদের সুরে সুর মিলিয়ে সিক্ত হতে শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা। বাদামতলায়ও উৎসুক অনেকেই ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকেই আবার চক্ষুলজ্জায় দূর থেকেই ঠোঁট মিলিয়ে শান্তি পাচ্ছেন। দমকা হাওয়া যেন অহিংসার বার্তা বয়ে নিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বাংলায়। সবার সম্মিলিত সুর জানান দিচ্ছে, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি। এমন মানবজনম আর কি হবে? মানব রূপে সৃজন হয়েও পশুত্বকে বলি না দিতে পারা, এ হেন মানবজনমের সার্থকতা কোথায়?
‘দেব-দেবতাগণ করে আরাধন, জন্ম নিতে মানবে…’ গাইতে গাইতে বাদামতলার ভিড় ঠেলে ঈষৎ কর্দমাক্ত লাল ইট ছেড়ে হেঁটে চলল ছেলেগুলো। যেন ঈশ্বর দূত হয়েই ওরা এসেছিল। কিছুক্ষণ ঈশ্বরের বার্তার জানান দিয়ে আবার চলল স্বর্গে। বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে রেখে গেল একঝাঁক প্রশ্ন, হায় মানবজনম, হায়!
লেখক : তাহমিদ হাসান, শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।