গাজীপুরে কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার এক নিভৃত গ্রাম কাওরাইদ। সুতি নদের তীরবর্তী এই জনপদেই শৈশবের দিনগুলো কাটিয়েছেন বাংলার পঞ্চকবিদের একজন অতুলপ্রসাদ সেন। সেই কাওরাইদেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর এক বর্ণাঢ্য আয়োজন।
ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে এবং নেতাজি সুভাষ-কাজী নজরুল সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সহযোগিতায় কাওরাইদ কালী নারায়ণ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ২৫ মে এর আয়োজনটি ছিল উৎসুক শিক্ষার্থী, প্রথিতযশা শিল্পী, সাংস্কৃতিককর্মী, গণমাধ্যমকর্মী ও বিশিষ্টজনদের এক মিলনমেলা।
ঢাকা থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে কাওরাইদের অধিবাসীদের জাতীয় কবিকে নিয়ে এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন প্রথমবার চাক্ষুষ করে যেমন অভিভূত হয়, তেমনি গুণী শিল্পীদের পরিবেশনায় সৃষ্টি হওয়া মোহময়তায় আবিষ্ট হন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে বিস্ময় আর গুণীজনদের অটোগ্রাফ সংগ্রহের চেষ্টা ছিল লক্ষ করার মতো।
জ্যৈষ্ঠের তপ্ত দুপুরে যখন কালী নারায়ণ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বিশাল স্টিলের প্যান্ডেলে নজরুলজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শুরু হয়, ততক্ষণে শিক্ষার্থী আর স্থানীয় মানুষদের উপস্থিতিতে টইটম্বুর গোটা মাঠ। প্রথমেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পান নজরুলের কবিতার আবৃত্তি আর নজরুলসংগীত পরিবেশনের। শিক্ষার্থীদের এই সুকুমারবৃত্তি অভিভাবকসহ স্থানীয় মানুষদের মুগ্ধ করে।
এরপরই শুরু হয় সেমিনার, ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’। বীর প্রতীক আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীর সভাপতিত্বে সেমিনারের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঢাকার পরিচালক মৃন্ময় চক্রবর্তী। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, ছায়ানট কলকাতার সভাপতি সোমঋতা মল্লিক ও নেতাজি সুভাষ-কাজী নজরুল সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
সেমিনারের পর মঞ্চে আসেন খ্যাতিমান বাচিকশিল্পী টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট নজরুলসংগীতশিল্পী সালাউদ্দিন আহমেদ, ফেরদৌস আরা, বাদমা মিয়া ও তাঁর দল।
সমাপনী পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি। বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।
দীপু মনি বলেন, ‘নজরুল তাঁর লেখায় বলেছিলেন, “বিশ্বভুবন দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে”, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য আজ আমরা সারা বিশ্বকে প্রযুক্তির মাধ্যমে হাতের মুঠোয় এনেছি। এটি তাঁরই সংকল্প। একজন কবির দূরদৃষ্টি কতটা প্রবল হলে তিনি এমন কবিতা লিখতে পারেন, তা আমাদের অনুভব করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নজরুলকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। তিনি কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে সাম্যের পক্ষে কথা বলেছেন। নজরুল আমাদের যে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভান্ডার দিয়ে গেছেন, এর মধ্যে আমাদের অবগাহন করতে হবে। তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের পথ সুগম হবে।’
প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ ঐতিহ্যের আইকন। তিনি যে মূল্যবোধ বিকিরণ করেছেন, তা বিশ্বমানবতার সম্মিলিত বিবেকের বাতিঘর, যা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।’
আতিউর রহমান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মহান সৃষ্টিকর্ম থেকে নির্যাস সংগ্রহ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নজরুল বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্পদ। আমাদের আরও গভীরভাবে নজরুলকে আঁকড়ে ধরতে হবে। তাহলেই আমরা কূপমণ্ডূকতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জয়ী হব, প্রগতির বাংলাদেশ গড়তে পারব।’
নেতাজি সুভাষ-কাজী নজরুল সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়ের স্বপ্নকে আরও বড় করে তুলতে জাতীয় কবির জন্মোৎসব গ্রামের এই বিদ্যালয়ে করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রাণিত করেছে। প্রান্তিক জনপদে নজরুলের জীবন ও সাহিত্যের চর্চা বেগবান করা না গেলে আমাদের জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটবে না। তৃণমূলে ঝিমিয়ে পড়া সাংস্কৃতিক চর্চাকে উচ্চকিত করতে এ ধরনের আয়োজনের বিকল্প নেই।’