মানবিকতার সংকট ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ভূমিকা: একটি বিশ্লেষণ
শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ সঠিকভাবে বিকাশিত হলে একটি সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। কিন্তু এগুলোর অভাবে বর্তমানে দেশে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। এর ফলে সমাজের সামগ্রিক চিত্রটা এককথায় বললে বলা যাবে যে সামাজিক উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে, যা মানবজীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শিক্ষা মানুষের মননশীলতা বিকাশে আর সংস্কৃতি আমাদের রীতিনীতি, ধর্মচর্চা, অভ্যাস, মূল্যবোধ, ইতিহাস ঐতিহ্য, শিল্প–সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে। এর ফলে সঠিক পন্থায় শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে আমাদের মূল্যবোধ, আচরণ, চিন্তা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীলতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার গুণাবলি বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এককথায় মানবচরিত্রে শিক্ষা ও সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যা মানবিক সমাজ গঠনে সব থেকে বেশি প্রয়োজন।
আমাদের দেশসহ দুনিয়াতে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রীতিমতো চোখে পড়ছে। এর ফলে দেশে দেশে যুদ্ধ, কলহ, বিবাদ লেগে আছে। মানবিক মূল্যবোধের সংকটের পেছনে সঠিক শিক্ষা ও ধর্মচর্চার অভাব, আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক কারণ, বেকারত্ব ইত্যাদি প্রভাব ফেলে। একটি জাতির নিজস্ব সত্তা প্রকাশে সংস্কৃতি মূল ভূমিকা রাখে। কিন্তু অবাধ আকাশ–সংস্কৃতির বিকাশ আমাদের সংস্কৃতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ভিনদেশের সংস্কৃতি আমাদের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মানানসই না হওয়াতে পারিবারিক কলহ দেখা যাচ্ছে, যা সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বলা হয়ে থাকে, শিক্ষা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলে, কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এটা পারছে না, বিশেষজ্ঞেরা এমনটাই বলছেন। শিক্ষা মানুষকে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা মানবিকতার সংকট উত্তরণে দিকনির্দেশনা দিতে পারছে না সঠিকভাবে। এর ফলে মানুষ হয়ে যাচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক।
এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও ভালোবাসা সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষা- সংস্কৃতির সঠিক চর্চা না থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, অন্যকে আঘাত করা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে দিন দিন আমরা দেশীয় সংস্কৃতিচর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এর ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে যে সহানুভূতিশীলতা, পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ, ন্যায়বিচারের মনোভাব ও শ্রদ্ধাবোধের যে ভিত্তিটা শক্তিশালী ছিল, তা এখন ভেঙে পড়ছে। তবে এই মানবিকতার সংকটকে কোনো হঠাৎ সমস্যা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এটিকে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের ফল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, বর্তমানে শিক্ষা হয়ে উঠেছে শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যম। শিক্ষাব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি করতে পারছে না। ইউনেসকোর এক প্রতিবেদনে (Global Education Monitoring Report, 2023) দেখিয়েছে, পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী এখনো ‘social and emotional learning’ বা মানবিক গুণাবলির পর্যাপ্ত শিক্ষা পাচ্ছে না। ২০২২ সালের বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (BBS) এক জরিপের তথ্য বলছে, দেশের ৭৫ শতাংশ তরুণ বছরে একবারও কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন না। যেখানে বলা হয়ে থাকে, মানবিক সমাজ গড়তে হলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করতে হবে। যেখানে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের কী হাল, তা সহজেই অনুমেয়।
সংস্কৃতি মানে কেবল বিনোদন নয়। বরং এটি ব্যক্তি ও জাতির আত্মপরিচয়, মননশীলতা ও নৈতিকতা গঠনে সহায়ক একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সৃষ্টিশীল কাজকর্ম, মূল্যবোধের বিকাশ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববান হওয়া, মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন, ন্যায়ের শিক্ষা দিতে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে শিক্ষা আমাদের ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে শেখায়। একজন শিক্ষিত মানুষ সমাজে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন। শিক্ষা মানুষকে সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণে উৎসাহিত করে, যা সুস্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। শিক্ষা মানুষকে মুক্ত চিন্তা করতে সহায়তা করে। মানুষের চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। এর ফলে সমাজ থেকে নানা ধরনের কুসংস্কার, হিংসা–বিবাদ, অমানবিক চিন্তা ও আচরণ দূর করা সম্ভব হয়। যার ফলে মানুষ খারাপ পথ থেকে বেরিয়ে এসে একজন মানবিক ও উদার মানুষে পরিণত হতে পারে। এ জন্যই নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ব্যক্তিত্বরা শিক্ষাকে মানবিকতার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছেন।
এখন মানবিক সমাজ গঠনে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়াচর্চা, সাংস্কৃতিক ও সমাজিক স্বেচ্ছাসেবক কাজের আয়োজন ও যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক হবে এবং নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবে। শিক্ষক ও অভিভাবকেরা সন্তানদের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবিকতা চর্চা করাবেন। এ জন্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনের ইতিহাস, বিভিন্ন সাহিত্য, উপন্যাসের বই পড়তে আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। দর্শন, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, গবেষণালব্ধ জ্ঞান বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন সভা–সেমিনারের আয়োজন করা যায়। বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে ভালো–মন্দ, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ পড়া ও সে অনুযায়ী জীবন যাপন করা হতে পারে উত্তম একটি মাধ্যম। এর ফলে বলা যায়, সঠিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা আমাদের সমাজব্যবস্থার নানা অসংগতি দূর করে একটি মানবিক সমাজ তৈরি করবে। বর্তমানে মানবিকতার যে সংকট দেখা দিয়েছে, এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে আমারা পিছিয়ে যাব। আধুনিক সভ্যতায় সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যম বিবেচনা করে মানবিকতার বিকাশের মাধ্যমেই এগিয়ে চলা সম্ভব। তা না হলে সামাজিক নানা ব্যাধির বিস্তার আমাদের জীবনচলার পথকে বন্ধুর করে তুলবে।
লেখক: শেখ সুলতানা সুখী, ব্যাংকার ও মো. শাহিন রেজা, চাকরিজীবী