স্কুলজীবনের যে স্মৃতি এখনো ভাসে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বয়স পাঁচ কিংবা ছয়, তবে আমার মনে আছে, এর মধ্যে মা আমাকে সঙ্গে করে স্কুলে ভর্তির জন্য নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভর্তি নেয়নি আমাকে; ওই যে আমি কান ধরতে পারি না মাথার ওপর দিয়ে। তবে আমার খুব ইচ্ছা ছিল স্কুলে ভর্তি হওয়ার। অবশেষে আমার গ্রামে সেই স্কুলে ১৬৭ নং বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ক্লাস ওয়ানে।

আমার বাসা স্কুল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ছিল। সঙ্গে আমার গ্রামের বন্ধুরাও ভর্তি হলো স্কুলে। অবশেষে আমরা ১ জানুয়ারি নতুন বই পেলাম। আহা! নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আমাদের মুগ্ধ করে। বই নিয়ে বন্ধুবান্ধবসহ বাসায় যাই হেঁটে হেঁটে। বাসায় গিয়ে নতুন বই আর স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথাটা আমি আমার গ্রামের সমস্ত মানুষকে জানিয়ে দিই। সত্যি সে সময় স্কুলে ভর্তি আর নতুন বই পাওয়ার আনন্দ আমাকে মোহিত করেছিল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সেদিন সন্ধ্যায় দাদুর কাছে নতুন বইয়ের মলাট লাগিয়ে নিই। দাদু সুন্দর করে মলাট লাগিয়ে দেওয়ার পর বইয়ের ওপরে আমার নাম-ঠিকানা খুব সুন্দর করে লিখে দিয়েছিলেন। আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি কিন্তু আমার দাদুর হাত ধরে।

সহপাঠীরা মিলে আমরা একসঙ্গে সকাল আটটায় বাসা থেকে বের হয়ে একসঙ্গে স্কুলে রওনা দিই। সবাই নতুন ব্যাগ, নতুন বই, নতুন ড্রেস পরে আনন্দের সঙ্গে স্কুলে আসি এবং দরজার শিকল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি কখন আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক মমতাজ ম্যাম আসবেন। দরজা খুলবেন, সে অপেক্ষায় আমরা প্রহর গুনতাম। কখন দৌড়ে গিয়ে ফাস্ট সিট ধরব। ফাস্ট সিট ধরতে গিয়ে দৌড়ানোর সময় আবার অনেকে আহত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ম্যাম চলে আসতেন ক্লাস নিতে। ক্লাসে জোরে জোরে ধারাপাত পড়া যেন এখনো বেজে ওঠে কর্ণকুহরে। আহা! সেই দিনগুলো যেন আর কখনো ফিরে পাব না।

স্কুলে এসে আমরা ক্লাসের ফাঁকে সহপাঠীরা মিলে নানা রকম খেলাধুলা করতাম, যেমন দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, চশমাচোর, ডাংগুলি, বউছি, কানামাছি, দৌড়খেলা এবং ফুটবল খেলেছি। খেলতে খেলতে আবার সহপাঠীদের সঙ্গেও করেছি অনেক মারামারি।

মনে পড়ে প্রাইমারি স্কুলজীবনে আমাকে বাসা থেকে প্রতিদিন এক টাকা করে দিত। সেই টাকা পেয়ে আমি মহাখুশি। আমাদের স্কুলের পাশে এক দাদির দোকান ছিল। তিনি শুধু পাঁপড় বিক্রি করতেন। তখন আমি সেই এক টাকা দিয়ে পাঁপড় কিনে খেতাম। আবার কখনো আইসক্রিমওয়ালাদের কাছে নারকেল আইসক্রিম কিনে খেতাম সহপাঠীদের সঙ্গে। এখন সেই দাদির হাতের ভাজা পাঁপড় আর নারকেল আইসক্রিম খুব মনে পড়ে। মন ফিরে যেতে চায় ফেলে আসা সেই ১৬৭ নং বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায়।

ক্লাসে পড়া না পারলে ম্যামদের কানমলা, বেতের বাড়ি, কান ধরে ওঠবস করা, এগুলো যেন ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। আসলে আমি লেখাপড়ায় খুব ফাঁকি মারতাম। খেলাধুলা, দুষ্টুমি—এগুলো ছিল আমার পছন্দের শীর্ষে।

বৃষ্টির হওয়ার আগমুহূর্তে দেখা যেত স্কুলমাঠে ফড়িংয়ের বিচরণ। সেই দৃশ্য দেখে আমরা সহপাঠীরা খুব মোহিত হতাম। সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতাম ফড়িং ধরতে। এমন সময় আমাদের ছুটির সময়ও হয়ে যায়। ছুটির পর পরনের প্যান্ট খুলে শার্টের মধ্যে বই পেঁচিয়ে মাথার ওপর বই নিয়ে ভিজে ভিজে সহপাঠীরা মিলে দুষ্টুমি করতে করতে বাসায় পৌঁছে যেতাম। ততক্ষণে আমার বই-খাতা ভিজে যেত। তখন আমার দাদি সেগুলো উনুনের আগুনে শুকিয়ে দিত।

স্কুলজীবনের স্মরণীয় দিনগুলোর মধ্যে ছিল অ্যাসেম্বলি। ছুটির শেষে আমাদের নিয়মিত অ্যাসেম্বলি হতো। ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার অনেকে অ্যাসেম্বলি করার ভয়ে পালিয়ে যেত। কিন্তু বড় ভাইয়েরা তাদের দৌড়ে গিয়ে ধরে নিয়ে আসত, অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে করে দিত।

এখনো ওই স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই, ফিরে যেতে চাই প্রাইমারি স্কুলের আঙিনায়। সময়ের সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শৈশবের দিনগুলোর মতো সবাই একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব হবে না সেই প্রাইমারি স্কুলের আঙিনায়। সবার আগমনে আর মুখরিত হবে না আমাদের সবার ফেলে আসা অতীত ১৬৭ নং বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

লেখক: মো. আজাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]