সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ফাইল ছবি

বিশ্বে একদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা, আরেক দিকে ব্যবসায়, শিল্পকারখানা, সেবা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা তথা সব ক্ষেত্রে চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির মাধমে স্বয়ংক্রিয়করণ। শ্রমবাজারে মানুষের শ্রমের পরিবর্তে ধীরে ধীরে বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার; যার প্রভাব পড়ছে আমাদের তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের ইন্ডাস্ট্রিতে। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও এর বাইরে নয়।

গত কয়েক দিনে দেশের মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংবাদ পাঠক দেখা গেছে, যার সূচনা করেছিল চীনের সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি। কম্পিউটার গ্রাফিকস ব্যবহার করে তারাই বিশ্বের প্রথম এআই-চালিত নিউজ অ্যাঙ্কর নিয়ে এসে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। নিউজরুমে কেবল সংবাদ পাঠই না, সংবাদ লেখা, অডিয়েন্স রুচি-অভ্যাস বুঝে সংবাদ পার্সোনালাইজেশন করা, ট্রান্সক্রাইব করা, স্থির ছবি, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট তৈরিসহ নানা কাজেই এখন এআই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

শিকাগোভিত্তিক টেক কোম্পানি ন্যারেটিভ সায়েন্সের ভাষ্য, ২০২৫ সালের মধ্যে একটি এআই বটই ৯০ শতাংশ খবর লিখে দেবে। তাদেরই সফটওয়্যার Quill যেটা বিস্তৃত তথ্যকে সহজপাঠ্য প্রতিবেদনে পরিণত করতে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের বড় বড় এবং স্বনামধন্য অনেক মিডিয়া হাউসই সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে। ওয়াশিংটন পোস্ট, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, বিবিসি, রয়টার্স, ব্লুমবার্গ, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, টাইমস এবং সানডে টাইমস, জাপানের ন্যাশনাল পাবলিক ব্রডকাস্টার, এনএইচকে এবং ফিনল্যান্ডের এসটিটি সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

নানা কাজে এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিউজরুমে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যেমন: কনটেন্ট তৈরি: ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং প্রোগ্রামগুলো মানুষের মতোই সাড়া দিতে সক্ষম হওয়ায় সাংবাদিকেরা এগুলো ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিস্তৃত তথ্য থেকে সহজপাঠ্য প্রতিবেদন লেখা, তথ্য যাচাই করার কাজ করতে পারছেন। যেমন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস Automated Insights নামের এআই সিস্টেম ব্যবহার করে, যা দিয়ে দৈনন্দিন পুনরাবৃত্তিমূলক সংবাদ নিবন্ধ, বিশেষ করে খেলাধুলা এবং ব্যবসা–সংক্রান্ত খবর লেখা যায়। রয়টার্স ‘Reuters News Tracer’ নামে এআই সিস্টেম ব্যবহার করে, যা রয়টার্সের সাংবাদিকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর খুঁজে পেতে এবং তথ্য যাচাই-বাছাই করতে সাহায্য করে। ফোর্বসও দৈনন্দিন পুনরাবৃত্তিমূলক ছোট সংবাদ নিবন্ধ এবং সারাংশ লেখার জন্য Bertie নামে এআই সিস্টেম ব্যবহার করে। আর এখন ওপেন এআইয়ের ChatGPT সবার কাছেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কারণ, এটা যেকোনো ধরনের বিষয় দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবেদন লিখে দিচ্ছে, বড় বড় প্রবন্ধ থেকে সারাংশ বের করে দিচ্ছে এবং প্রোগ্রামিংয়ের মতো সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে।

নিউজ পার্সোনালাইজেশন

এআই-চালিত অ্যালগরিদমগুলো পাঠকদের আগ্রহ এবং পছন্দ ট্রেস করে সেই অনুসারে সংবাদকে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারে। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যখন স্ক্রল করি, তখন একটি সংবাদে ক্লিক করলে সেই ধরনের আরও সংবাদ আমাদের কাছে রিকমন্ডেশন হিসেবে চলে আসে। The Times-এর JAMES নামের এআই প্রোগ্রাম পাঠকের অভ্যাস, আগ্রহ এবং পছন্দ ট্রেস করে তার কাছে সেই ধরনের সংবাদের নোটিফিকেশন পৌঁছে দেয়।

অটোমেটেড রেগুলেশন

অটোমেটেড রেগুলেশন সিস্টেমের মাধ্যমে মিডিয়া হাউসগুলো তাদের সাইটে সংবাদ বা অন্যান্য নিবন্ধে পাঠক মন্তব্য রেগুলেট করতে পারে, নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অটোমেটিক ফটো-ট্যাগিং, ভিডিও এডিটিং, ভয়েস প্যাকেজিং, ডেটা মাইনিং ইত্যাদিসহ নানা ধরনের কাজ সম্পাদন করতে পারে।

ফ্যাক্ট-চেকিং

বেশ কিছু নিউজ আউটলেট আছে, যারা তাদের রিপোর্টিংয়ে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করতে সাহায্য করার জন্য স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্ট-চেকিং টুল ব্যবহার করে। এই টুলগুলো Natural Language Processing (NLP) এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে। যেমন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস খবরের সত্যতা যাচাই করতে সাহায্য করার জন্য ‘Verify’ নামের একটি টুল ব্যবহার করে। রয়টার্সও ব্যবহার করে নিজেদের ডেভেলপ করা ‘Reuters Fact Check’ এবং ওয়াশিংটন পোস্ট ব্যবহার করে ‘Heliograf’। আবার ফ্যাক্টমাটা নামের একটি কোম্পানি আছে যারা টাইমস অব লন্ডন, দ্য গার্ডিয়ান এবং নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো সংবাদ হাউসগুলোতে ফ্যাক্ট চেকিং সুবিধা সরবরাহ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভাইরাল সংস্কৃতিতে ভুয়া তথ্য ও সংবাদ প্রতিহত করতেই দিন দিন ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের গুরুত্ব বাড়ছে।

অডিয়েন্স অ্যাক্টিভিটি বৃদ্ধি করা

এআই ব্যবহার করে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো অডিয়েন্সের অভ্যাস, রুচি এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে। সংবাদ সাইটগুলোকে আরও প্রাসঙ্গিক এবং আকর্ষণীয় করে সেখানে অডিয়েন্সকে বেশি সময় ধরে এনগেজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও পিছিয়ে নেই। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ত্বরিত গতির বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিউজরুমের কাঠামোয় তারাও আনছে পরিবর্তন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাজারে টিকে থাকতে তারা নিচ্ছে ‘ডিজিটাল ফার্স্ট’ হাউস পলিসি, ঢেলে সাজাচ্ছে নিজেদের বিজনেস মডেল। আগের সেট-আপ ভেঙে দিয়ে নিউজরুমে ডিজিটাল সেকশনের জন্য ছেড়ে দিচ্ছে বেশি জায়গা, বেশি রিসোর্স এবং নিয়োগ দিচ্ছে ডিজিটাল মিডিয়ামে জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন জনবল। পরিবর্তন এসেছে সংবাদ সোর্সিং, সংবাদ লেখা, উপস্থাপনা, বণ্টন, বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ নানান দিকেও।

ওপরের আলোচনা থেকে এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে আগামী দিনগুলোতে এআই প্রযুক্তি আরও বহু গুণ, বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হবে। এটা একদিকে নিউজরুমকে যেমন গতিশীল করছে, আরেক দিকে জন্ম দিচ্ছে কিছু চ্যালেঞ্জেরও।

যেমন মানুষ যেভাবে সংবাদকে বিশেষ স্থানিক ও কালিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি, ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করতে পারবে, অনুসন্ধান চালাতে পারবে, তা এআই পারবে না। ফলে সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সাংবাদিকদের প্রয়োজন কখনোই ফুরিয়ে যাবে না; কিন্তু পুনরাবৃত্তিমূলক প্রতিবেদন লেখার কাজগুলোর জন্য আলাদা লোকবলের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। অনেক সাংবাদিকের চাকরিই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কারণ, এআই মানুষের চেয়ে হাজার গুণ কম সময়ে, বিস্তৃত তথ্যভান্ডার থেকে মুহূর্তেই সারাংশ বের করে দিয়ে সংবাদ লিখে দিচ্ছে। বিষয়টি মানুষের সৃজনশীলতার জন্য যেমন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি আবার কনটেন্টের অথরশিপ কীভাবে নির্ধারিত হবে, তা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি করে।

এ ছাড়া মানুষ লিখেছে, নাকি এআই লিখেছে, সেটি অডিয়েন্সের কাছে স্পষ্ট না থাকায় সাংবাদিকতার যে অবজেক্টিভিটি বা ক্রেডিবিলিটির জায়গা, সেটিও চালেঞ্জের মুখে পড়ে।

এআই ট্রেসিংয়ের মাধ৵মে পাওয়া তথ্য অনুসারে পাঠক, দর্শকের অভ্যাস, রুচি ও আগ্রহ অনুযায়ী একই ধরনের কনটেন্ট তাকে ফিড করতে থাকলে, তার মধ্যে আগে থেকেই বিরাজমান ছাঁচিবদ্ধ ধারণা, পক্ষপাত আরও জোরদার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করবে। ফিল্টার বাবল, একো-চেম্বারগুলো আরও জোরালো হবে এবং মতামতের যে বৈচিত্র্য, বহুমতের যে প্রতিফলন, তা কমে যাবে। খুব সহজেই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, ভুল ও ক্ষতিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে এবং প্রকৃত তথ্যের প্রচার রুখে দেওয়া সম্ভব হবে।

অনায়াসে মতামতের মেরুকরণ করা সম্ভব হবে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির জায়গা থেকেও এআই প্রশ্নবিদ্ধ; কারণ, এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যেভাবে মানুষকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখবে তাদের আচরণ, অভ্যাস, রুচির তথ্য ট্রেসিংয়ের জন্য, তা মানুষের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিয়ে জটিলতা তৈরি করবে।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয় এবং তা যুক্তিযুক্তও নয়। তবে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে আগে থেকেই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন সাংবাদিকতায় এআই কতখানি ব্যবহৃত হতে পারে, তার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশিকা এবং নৈতিক মানদণ্ড তৈরি করতে হবে যেন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করা যায়। সাংবাদিকতার শিক্ষা-কারিকুলামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়গুলো যুক্ত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা এআই পরিচালিত সিস্টেম, তথ্যপ্রযুক্তি–সম্পর্কিত টুলস ব্যবহারে দক্ষ হয়ে ওঠে। ডিজিটাল লিটারেসি, ডেটা অ্যানালাইসিস, ডেটা ভিজু৵য়ালাইজেশন, মাল্টিমিডিয়া স্টোরিটেলিং, ফ্যাক্ট-চেকিং, সাইবার সিকিউরিটি, সোশাল মিডিয়া প্রমোশন, মনিটাইজিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদির ধারণাগুলো কারিকুলামে যোগ করতে হবে। কেবল থিওরি–নির্ভর পড়াশোনা থেকে সরে আসতে হবে। দক্ষতাসম্পন্ন লেখনীর ওপর জোর দিতে হবে। এ ছাড়া সংবাদ হাউসগুলোয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন তাঁরা চাকরি না হারিয়ে বরং ডেটা অ্যানালাইসিস এবং অটোমেশনের মূল বিষয়গুলোতে পারদর্শী হয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য মূল্যবান জনসম্পদে পরিণত হতে পারেন। নিউজরুমে মানবীয় দক্ষতা এবং এআইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে যেন উভয় শক্তিরই সুফল পাওয়া যায়। এআই–নির্ভর প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অ্যালগরিদম, ডেটা সেট, ডেটা সোর্স সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যেন জবাবদিহি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় থাকে। এআইয়ের প্রভাব সম্পর্কে পাবলিক ডিসকোর্স তৈরি করতে হবে এবং সাংবাদিকতায় এআইয়ের প্রভাব বুঝতে এবং এর ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার পথনির্দেশিকা বের করতে গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে।

সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও যোগাযোগের বিষয়গুলো মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই প্রযুক্তির দ্বারা প্রভাবিত, পরিবর্তিত হয়ে আসছে। গুটেনবার্গের প্রেস, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট এবং একই ধারাক্রমে এআই পুরো সংস্থাপন বদলে দিচ্ছে। তবে বদলে যাওয়াটাকে যেন ভয়হীন করা যায়, সে বিষয়ে আগে থেকেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে রিপ্লেস করে না দিয়ে বরং মানুষের কাজে সহায়ক টুলসেই সীমাবদ্ধ থাকে।

  • লেখক: নাসরিন আক্তার: সহকারী অধ্যাপক, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ