মননে মাননীয়

শিক্ষকতাপ্রতীকী ছবি

‘সমুদ্রের জল কভু শুকায় না
পাপ কভু লুকায় না।’

নেকার বুকারের ফিতার মধ্যে দুই হাতের দুই বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে মনিরুজ্জামান স্যার শান্ত কণ্ঠে আওড়ালেন। তাঁর চশমার ভারী কাচের ভেতর দিয়ে বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তিনি কিছু বলতে চাইছেন। বাংলা শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্যার একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির এমএ।

এতে করে ওই দুটি ভাষায় স্যারের অগাধ পাণ্ডিত্য। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চলার পথের পাথেয় হিসেবে অনেক নীতিকথা কবিতার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন। স্যার বলেন, ‘সমুদ্র বিশাল। যতই পানি সরিয়ে নাও না কেন, এর বিশালত্ব কমবে না; তেমনি কেউ যদি কোনো পাপ কাজ করে থাকে, সেটাও আজ নয়তো কাল প্রকাশ পাবেই। এর শাস্তি মানুষকে ভোগ করতেই হবে।’

একসময় আবুজর গিফারী কলেজে আব্বার সহকর্মী হিসেবে শিক্ষকতা করায়, আমাকে স্নেহ করেন মনিরুজ্জামান স্যার। সুবেশধারী ও আধুনিক পোশাকে স্যারকে দেখলে মনে হয়, এই দেশকে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই তাঁর আছে। একটা সময় নতুন স্থাপিত বাংলাদেশ রাইফেলস হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে অবসরের আগে স্কুলটিকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজ’–এ উন্নীত করে দিয়ে যান। কলেজটিকে পরিণত করেন ঢাকার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

আমাদের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের শিক্ষকেরা সবাই একেকজন রত্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একই বছরে (৩০.০১.১৯২০) প্রতিষ্ঠা পাওয়া তৎকালীন ঢাকা শহরের সর্বপশ্চিমের এই হাইস্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ চাঁদ বকস মিঞা। দুই ভাই সতীশ চন্দ্র দাস ও সুবোধ চন্দ্র দাস তাঁদের স্বর্গীয় মা–বাবা রাধারানী দাস ও কৈলাস চন্দ্র দাসের স্মৃতি রক্ষার্থে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। স্কুলটির শিক্ষা অন্তপ্রাণ শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রচেষ্টায় একসময় উৎকর্ষের চূড়ায় পৌঁছে যায়। প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দিন স্যারের সময় পুরো বাংলাদেশের ছাত্রদের প্রথম পছন্দে পরিণত হয় এই ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, সাহিত্যিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসসহ অনেক নামজাদা মানুষ এখানে শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের পথ দেখিয়েছেন।

২.

‘স্যার, আপনি কি আমাদের উচ্চতর গণিত বইয়ের একজন লেখক?’ দশম শ্রেণির ফার্স্ট বয় বাবু ভাই বোর্ডের মাধ্যমিক উচ্চতর গণিতের রচয়িতা-সম্পাদনা পরিষদের ‘মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন’ নামটির ওপর গভীর মমতায় তর্জনী রেখে বললেন। জবাবে মিতভাষী, প্রচণ্ড ভদ্র ও নিরহংকার মানুষ অঙ্কের জাদুকর হাফিজউদ্দিন স্যার মিটিমিটি করে হেসে মাথা দোলান। আমি চোখের সামনে বোর্ডের অঙ্ক বইয়ের একজন রচয়িতাকে দেখে ঢোক গিললাম।

‘কী সাংঘাতিক, স্যার তো নিজ থেকে কিছু বলেননি। এত অমায়িক!’ মনে মনে বলতে লাগলাম। শেখ সাহেব বাজার রোডের স্যারের টিনশেড বাসাটির সামনের বারান্দায় দশম শ্রেণি ও মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বড় ভাইদের ভেতর আমি নবম শ্রেণিতে পড়া একমাত্র ছাত্র। ভোরবেলায় স্যারের কাছে পড়তে যাই। স্যার ড্রইং রুমের দিকে গেলেই বড় ভাইরা বানরের মতো লাফ দিয়ে পেয়ারাগাছে উঠে পড়ে। প্যান্টের পকেট ভর্তি করে পেয়ারা নিয়ে নিমেষেই আবার পড়ার টেবিলে ফিরে আসে। স্যার ওদের যেসব অঙ্ক দিয়ে যান, এর মধ্যে কঠিন কয়েকটি বড় ভাইয়েরা আমার বইয়ে দাগিয়ে স্যারের কাছ থেকে বুঝে নিতে বলে। ধীমান হাফিজউদ্দিন স্যার মাধ্যমিকের ছাত্রদের দুর্গতি দেখে আফসোস করেন। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর, ‘দুষ্টু বড় ভাইদের সঙ্গে বসলে সুমনও দুষ্টু হয়ে যাবে’ বলে আমাকে ড্রইংরুমে অগ্রণী স্কুল আর হলিক্রস কলেজের আপাদের পাশে বসিয়ে দেন। দুদিন পর আবারও ‘ছোট ভাইয়া, তুমি এই অঙ্কটা একটু স্যারের কাছ থেকে তুলে নাও না’ বলায় শেষ পর্যন্ত স্যার আমাকে দূরবর্তী একটি টেবিলে আলাদা বসার ব্যবস্থা করে দেন। ভোলাভালা মানুষ স্যারকে পেলে নবাবগঞ্জ  বাজারের কসাই, মাছওয়ালা, তরকারিওলা গছিয়ে দেয় সব অচল মাল। মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী স্যার তাদের কুকর্ম ধরতে পারেন না।

‘এই তোরা কে বলতে পারবি, ফিউচার পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেন্সের সূত্রটি’ বললেন আশরাফুল হক স্যার। আস্তে করে ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের হেডস্যার আবদুর রশিদ সরকার স্যারের ইংরেজি গ্রামার বইয়ে মাথা গুঁজে দিই। আমার সামনের বেঞ্চে দুইজন লম্বা বন্ধু থাকার পরও বইয়ের আড়ালটা নিতে হয়! স্যারের ছয় ফুট উচ্চতা আর বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ব্যায়াম করা পেশিবহুল শরীরের ব্যস্তানুপাতিক ওনার মেজাজ।

পড়ানোর সময় খুব আনন্দের সঙ্গে পড়ান, চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত হাত তোলা ইংলিশম্যান রুবেল আর সেকেন্ড বয় চন্দনের মধ্যে প্রথমজনকে বেছে নিলেন স্যার। ফটাফট প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে উদাহরণ দিয়ে রুবেল স্যারের মুখ উজ্জ্বল করল। এই খুশিতে স্যার আবার আমাদের পুরস্কার হিসেবে ক্লাস শেষে একটি গল্প বলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। ছাত্রদের উজ্জীবিত করার মন্ত্র জানতেন আমাদের ইংরেজি শিক্ষক যশোরের আশরাফুল হক স্যার। অতিশয় দুষ্টু ছেলেরাও গোগ্রাসে গিলত সারা জীবন নিরাভরণ সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত স্যারের লেকচার।
শামসুদ্দিন ভবনের শ্রেণিকক্ষ থেকে ফাঁকে ফাঁকে আমরা উল্টোদিকের একতলা টিনশেডের রসুইঘরের দিকে তাকাই। আজ ডেপটি মামুরা লুচির সঙ্গে ভাজি না মিষ্টি দেবেন, ক্লাস ক্যাপ্টেনকে একজন জিজ্ঞেস করে। প্রথম পিরিয়ডে রসুইঘর থেকে একজন এসে হিসাব নিয়ে যায় কজন ছাত্র আছে। ক্যাপ্টেন অতিরিক্ত তিনজনের সংখ্যা ঢুকিয়ে দেয়। দপ্তরি মামু গাঁইগুঁই করলে বলে, একজন টয়লেটে গেছে, আর দুইজন পানি খেতে গেছে।

৩.

সপ্তম শ্রেণিতে বিষ্ণুচরণ পাঠাগারসংলগ্ন শ্রেণিকক্ষে কডের প্যান্ট পরা ঝকঝকে ফরসা বর্ণের স্মার্ট শাহেদ চৌধুরী স্যার প্রথম দিনই আমাদের মন জয় করেন। বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে ক্লাস করার জন্য কক্সবাজারের কলেজ থেকে এসেছি।’ প্রথম দিনে হাত-মুখ নেড়ে চোখে-মুখে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলেন, ‘বাঘ কীভাবে ডাকে, জানো? হালুম!’ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বাংলা বইয়ের খটোমটো প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাগুলো ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি ক্লাসের চালু শব্দগুলোও আত্মস্থ করে ফেলেন তিনি। পড়াতে পড়াতে ক্লাসের ‘জাতীয় মামাকে’, ‘এই মামু, তুমি বলো’ বলায় পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ে। সপ্তম শ্রেণিতে ক্লিন শেভ করা বন্ধুটি আমাকে নিয়ে টিচার্স রুমে ভয়ে ভয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে শাহেদ চৌধুরী স্যারকে খুঁজতে থাকে। স্যারের কাছে অনুযোগ করে, ‘সবাই আমাকে মামা বলে খ্যাপায়, আপনিও স্যার আমাকে এটা বললে কোথায় যাব?’ স্যার অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বন্ধুটিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমায় তুমি ক্ষমা করো। আমার প্রতি তোমার রাগ কি কমেছে?’ স্যারের আন্তরিকতায় আমি ও বন্ধু হতচকিত হয়ে যাই। পরবর্তীকালে স্যারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্রে পরিণত হয় আমাদের সেই বন্ধু।

সে তার লেখা কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রথমে স্যারকে দিয়ে পরিশুদ্ধ করিয়ে নেয়। ‘আচ্ছা শাহেদ চৌধুরী স্যারের বাসা চেনো?’ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের বন্ধু শুভ্র জানতে চায়। সে হলিক্রস কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, উদয়ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মতো স্যারের কাছে পড়তে চায়। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলি, ‘স্যার আমাদের ক্লাসে যেভাবে পড়ান, এতে করে প্রাইভেট পড়ার দরকার নেই।’

অনেক ভোরে নিপোর্ট হয়ে শেখ সাহেব বাজারের গলির ভেতর দিয়ে একসঙ্গে চার–পাঁচজন ধাক্কাধাক্কি করতে করতে অঙ্কের স্যার আবদুস সোবহান স্যারের কাছে পড়তে যাই। এর মধ্যে তুহিন আর ইমন কিছুটা কুণ্ঠিত। আজকে স্যার দুই ফাঁকিবাজকে পড়া ধরবেন। গতদিন অঙ্ক না পারায় স্যার প্রচণ্ড খেপে বিশাল হাতের পাঞ্জা তুলে পিঠে ভাদ্র মাসের তাল ফেলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্রেক কষেন, ‘কাল অঙ্ক না পারলে গুলি করমু।’ স্যার সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে অঙ্ক করানোর পরও দুই–একজন অমনোযোগী ছাত্র মাঝেমধ্যেই স্লিপ কাটে। সব সময় স্যার মুখে যতই হুমকি দেন, কখনোই ছাত্রদের গায়ে হাত তোলেন না। শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় সকালটা কাটায়, তুহিন সবার কাছ থেকে চার আনা-আট আনা করে নিয়ে বাকরখানি-মিষ্টি কিনে মিষ্টিমুখ করায়। এই সড়ক ধরে সকালে খুব সাবধানতার সঙ্গে আসতে হয়। হাজারীবাগের ট্যানারি অভিমুখী ঠেলাগাড়িভর্তি লবণ মাখানো চামড়ার জন্য চোখ-কান-নাক সামলে পথটা পাড়ি দিই।

৪.

মোহাম্মদী বেগ ফিল্মি কায়দায় হু হু হো হো করে সংলাপ আওড়ায়, ‘তোমাকে কে রক্ষা করবে, সিরাজ?’ পুরো ক্লাস মোহাম্মদী বেগরূপী জাভেদের সংলাপ শুনে হেসে ওঠে; এমনকি আমাদের বাংলা ম্যাডামও। সাহিত্যিক সিকানদার আবু জাফর রচিত ‘সিরাজউদ্দৌলা’ আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পাঠ্য। বাংলা শিক্ষক রাশিদা জামান ম্যাডামের পড়ানোর ধরনটাই অন্য রকম। একসঙ্গে অনেকজনকে পড়ায় সম্পৃক্ত করেন। ম্যাডাম আট–নয়জন ছাত্র-ছাত্রীকে বিভিন্ন চরিত্রের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। সবাই এক সারিতে দাঁড়ায় সামনের ডায়াসে। যার সংলাপ, সে শুধু দুই পা এগিয়ে তার অংশটি বলে। এর ফাঁকে ফাঁকে ম্যাডাম ওই অংশের কার্যকারণ ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। বোর্ডের বাংলা বইয়ের সম্পাদনা-রচনা টিমের সদস্য অত্যন্ত সাদাসিধা রাশিদা জামান ম্যাডাম যে বিখ্যাত গীতিকার, সাহিত্যিক অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের অর্ধাঙ্গিনী, সেটা জানতে পারি অনেক দিন পর।

ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজে ভর্তির পর বিখ্যাত সব ছাত্রনেতাকে মল চত্বর, ফুলার রোডে প্রায়ই দেখতে পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করি। দ্বিতিয় বর্ষে উঠতে উঠতে কলেজের পার্শ্ববর্তী শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) বারান্দা দিয়ে ফাঁকি দেওয়ার পথ আবিষ্কার করে ফেলি। ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ মোহসীন হল, জহুরুল হক হল আর এফ রহমান হলের আশপাশের রাস্তা দিয়ে ভয়ে ভয়ে কলেজে আসি তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের ঘাঁটি থাকায়। চোরের দশ দিন, সাধুর এক দিন। এটার প্রমাণ পেলাম একদিন আইইআরে সাদেকুন্নাহার ম্যাডামের হাতে ধরা খেয়ে। ম্যাডাম ক্লাসে আন্তরিকতার সঙ্গে ম্যান্ডেলের সূত্রসহ জীববিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো ধীরে ধীরে আমাদের বুঝিয়ে পড়ান। কেন তিনি ঢাকা বোর্ডের ওই বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক, এটা ওনার পড়ানোর মুনশিয়ানায় আমরা টের পাই।

৫.

‘এমন (ইমন), আজকে এত্তেফাক দেয় নাই?’ মোয়াজ্জিন হুজুরের হাঁক। সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা মসজিদের মোয়াজ্জিন সাহেব শামসুল হক হুজুর আমাদের প্রতিদিন কোরআন শরিফ পড়াতে আসেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকা পড়েন না। ন্যূনতম চাহিদা মিটলেই হুজুর খুশি; অতিরিক্ত কোনো কিছুর প্রতি তাঁর লোভ নেই। প্রতিদিন কমপক্ষে চারবার হুজুরের কণ্ঠে আজান শুনি। আলাদা রকম বৈশিষ্ট্য, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মসজিদের আজান থেকে একনিমেষে আলাদা করা যায়। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার পশ্চিম দিকের বাউন্ডারি ঘেঁষেই আমাদের ৩২ নম্বর ভবন। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯১৩ সালে আজিমপুরে স্থানান্তরিত এতিমখানাটি বিশাল কম্পাউন্ডের মধ্যে অবস্থিত। ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য আছে আলাদা বাউন্ডারি দেওয়া হোস্টেল। ছাত্রদের কারিগরি বিদ্যা শেখানোর আলাদা ভবন, অফিস, মসজিদ প্রতিটি স্থাপনা মোগল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তৈরি। ভেতরে বিশাল ফুলের বাগান, মসজিদের পাশের সুদৃশ্য ওজু করার হাউস আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বেড়ানো আর ফুল কুড়ানোর স্থান। দুইতলা এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের দ্বিতীয় তলায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয় এবং নিচতলায় আছে মক্তব। খোলামেলা মসজিদটির মতো এখানকার ইমাম সাহেব, মোয়াজ্জিন সাহেব, খাদেম প্রত্যেকেই আমাদের আপনজন।

আম্মা সাহায্যকারীকে নিয়ে সকাল থেকে রুটি বানাচ্ছেন আর সেঁকছেন। বুটের হালুয়া গতকালই বানিয়ে রেখেছেন। আর সুজির হালুয়ার সঙ্গে গরম গরম রুটি। আমি, ইমন আর বাসার সাহায্যকারী খুরশেদ দরজায় কড়া নাড়লেই দৌড়ে রুটি–হালুয়া দিয়ে আসছি দুস্থ মহিলা ও বাচ্চাদের। আম্মাকে জানিয়ে দিয়েছি যে দুপুরের পর কোনো কাজ করব না; মাঠে যাব। শবে বরাতের বিকেল থেকেই বিকট শব্দে পটকা ফুটতে শুরু করে। সন্ধ্যায় তারাবাতি, মরিচ বোমা, রকেট বোমের ফুলঝুরি দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু এই আনন্দ আর আওয়াজে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের যে কষ্ট হয়, সেটা অনেকের মতো আমরাও বুঝতে পারি না। এতিমখানা মসজিদের ইমাম সাহেব মোহাম্মদ ইব্রাহীম বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই মসজিদে অনুরোধ করেন এ ধরনের পটকা না ফাটানোর জন্য।

শুধু ইমাম সাহেবের পেছনে নামাজ আদায় করার জন্য এবং তাঁর দরাজ কণ্ঠের খুতবা শোনার জন্য জুমার নামাজ, তারাবিহর নামাজ, শবে বরাত, শবে কদরের রাতে আজিমপুর ছাড়া লালবাগ, শেখ সাহেব বাজার থেকেও অসংখ্য মুসল্লি এতিমখানা মসজিদে আসেন। রাত জেগে নফল নামাজের ফাঁকে ফাঁকে একসঙ্গে আল্লাহর জিকির করার পর সব গুনাহ মাফের জন্য হুজুরের মোনাজাতের সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিরা আল্লাহর কাছে ‘আমিন আমিন’ বলে পানাহ চান। ইমাম সাহেব মোনাজাত করেন, ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা’। কবরবাসী পূর্বপুরুষ আর মা-বাবার জন্য ডুকরে কেঁদে ওঠেন মুসল্লিরা।

  • লেখক: আসফাক বীন রহমান; সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]