প্রদর্শনী: আদিম সময় থেকে বর্তমান যাত্রা
ঢাকার লালমাটিয়ার আর্ট বাংলা গ্যালারিতে উদ্বোধন হয়ে গেল শিল্পী হাসান কবীরের ‘দ্য জার্নি উইদিন’ শিরোনামের প্রথম একক প্রদর্শনী। ৯ জুন প্রদর্শনীটির উদ্বোধন হয়, চলবে ১৫ জুন পর্যন্ত।
আদিম ও বর্তমানকে একই সুতায় রাখার যে প্রবণতা; কিংবা আদিম সময়ের পুনর্বিন্যাস করাই ছিল শিল্পীর মূল উদ্দেশ্য। মূলত, এই প্রাচীন পথে হেঁটে তিনি বুঝতে চেয়েছেন বর্তমানকে। অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজির লিটন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন শিল্পসমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য, রশীদ আমিন ও আর্ট বাংলার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস।
ভাষা জন্মের আগে আমাদের আদি পৃথিবী কেমন ছিল? প্রাগৈতিহাসিক টারান্টিয়ান আমলেই শুরু হওয়া গুহাচিত্রগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যায় সেই সময়ের জীবন নিয়ে। এরপর চাওভেত, লাসকো আর আলতামিরা গুহায় পশুর চর্বি, রক্ত ও মাটির নানান রং দিয়ে দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে যেসব ছবি, মূলত ভাষা বলতে তা-ই ছিল তখন।
মানুষের খাদ্যাভ্যাস, সম্পর্ক ও বিশ্বাস—এই বিশ্বাস, তথা জাদুবিশ্বাসের খোঁজ পাওয়া যায় সেসব চিত্রকর্ম থেকে। মানুষ বিশ্বাস করত যে প্রাণীটি আঁকা হবে দেয়ালে, সেটি পরবর্তী সময়ে শিকার করা সম্ভব। তাই পুনরাবৃত্ত হয়ে এই ছবিগুলোতে এসেছে বাইসন। এসব ছবিতে আঁকিয়েদের যে পারদর্শিতা দেখা গেছে, বলা যায়, মডার্ন আর্টের শুরু মূলত তখনই। শিল্পবোদ্ধারাও বিংশ শতাব্দীর আধুনিক চিত্রকর্ম বা গুহাচিত্রের কথাই শুরুতে বলে থাকেন।
শিল্পী হাসান কবীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। তাঁর শিক্ষাজীবনের পরবর্তী সময়ে এসে নিজের একক প্রদর্শনীতে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি সিরিজ চিত্রকর্ম রেখেছেন। তবে বর্তমানের নিরীক্ষাধর্মী কাজের বাইরে কেন তিনি বেছে নিলেন এই আদিমতা? এর উত্তর ভাবতে পারি—আমরা আমাদের আদিকে উপেক্ষা করে চলতে পারি না কখনো। সময়ের সঙ্গে যেসব পরিবর্তন, সেগুলো গ্রহণ করতে হলেও আমাদের ধারণ করতে হয় পুরোনোকে।
আদিম শিল্পের যে চিহ্নধর্মিতা, সহজ আঙ্গিক ও চিন্তার গভীরতা—এ পথ ধরেই আধুনিক শিল্পীরা নতুন ধরন খুঁজে পেয়েছিলেন। হাসান কবীরও হাঁটতে চেয়েছেন এমনই এক পথে। তাঁর ‘প্রিমিটিভ রিফ্লেকশন: দ্য রুটস অব মডার্ন আর্ট’ সিরিজের ১৮টি ছবিতে তিনি পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন শিকারি, জন্তু ও অন্যান্য বিষয়কে। ঠিক যেমনটা দেখা যেত গুহাচিত্রে। কোথাও হয়তো আদিম সেই পাতা পুড়ে যেতে চাইছে, নতুন এসে যখন হটিয়ে দিচ্ছে পুরোনোকে, শিল্পী ফোড়ন কেটে তাঁর ক্যানভাসে দুটি সময়কে জোড়া দিতে চেয়েছেন।
রোমান্টিসিজম সময়ের দেলাক্রয়েজ, গয়া, কনস্টেবল, টার্নার প্রমুখ শিল্পী প্রতিবাদ করেছিলেন শিল্পায়নের নামে। প্রকৃতি ফিরে পেতে তাঁরা এঁকে গেছেন প্রকৃতির দুর্দশা আর প্রকৃতিই। শিল্পীরা যুগ যুগ ধরে আদিম আর অরণ্যেই ফিরতে চেয়েছেন। আর বর্তমান পরিবেশ দুর্যোগে শিল্পী হাসান কবীর তাঁর ‘ইন টু দ্য পলিউশন’ ছবিতে যে দুর্যোগ এবং একই সঙ্গে উত্তরণের আভাস দেখিয়েছেন, তা সময়সাপেক্ষেই যুক্তিযুক্ত। নগরায়ণ আর দূষণের মুখে খুলে দেওয়া জানালার গাছটিই বাঁচার উপায়। এ ছাড়া ‘দ্য পোয়েট্রি অব ওয়াননেস’ শীর্ষক ভিডিও আর্টে কাদামাটিতে মিশে গিয়ে আনন্দ আহরণের পারফরম্যান্স আর্টটিও পরিবেশদূষণের প্রতিবাদ।
শিল্পী হাসান কবীর তাঁর ‘ডেজার্ট আইল্যান্ড’ সিরিজের ছবিগুলোয় মূলত পরাবাস্তব এক জগৎ দেখিয়েছেন। সেটি এই পৃথিবীর মতনই, সেখানেও রয়েছে কাম, ক্রোধ, বাসনা, জন্ম। তবে চরিত্রগুলো ভিন্ন।
মাছের মতন, আবার ঠিক মাছ নয়, মাতৃত্বের কোনো এক চিহ্ন, একটি বেঁচে থাকার পরিক্রমা। সালভাদর দালি আর রেনে ম্যাগ্রিতের কাজের কথা মনে পড়তে পারে এসব চরিত্র দেখে। ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর সঙ্গমে যে নতুন এক সত্তা হয়, এমনই অ্যাবসার্ডিটি আর ভিন্ন বাস্তবতা এই ছবিতে।
শিল্পী কেবল পুরোনোকে অর্ঘ্য প্রদান নয়; বরং দুটি সময় এক করে নতুন একটি সময় দেখিয়েছেন। এখানে বিষাদ আর হাহাকারের পাশাপাশি দেখা যায় ব্যাপক সম্ভাবনা।
ঋতুপর্ণা দেবনাথ: গ্র্যাজুয়েট, অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়