বই, বই কেনা এবং লাইব্রেরি

বইমেলাফাইল ছবি: প্রথম আলো

শিরোনাম নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু শিরোনামে একটা ভুল করে আটকে গেছি। শিরোনামে ‘পাঠাগার’ না লিখে ইংরেজি ‘লাইব্রেরি’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। আমরা মুখে কথা বলার সময় দু-চারটা ইংরেজি কথা বলে ফেলি। কিন্তু যখন বাংলা লিখি, তখন চেষ্টা করি সেখানে যেন ইংরেজি শব্দ ঢুকে না যায়। তারপরও এই লেখার শিরোনামে বাংলায় পাঠাগার না লিখে ইংরেজিতে ‘লাইব্রেরি’ লিখেছি। তার একটা কারণ আছে, পাঠাগার কথাটার একটা গাম্ভীর্য আছে, একটা ঐতিহ্য আছে। আমার হালকা কথাবার্তা দিয়ে এত সুন্দর শব্দটার অপমান করতে ইচ্ছা করছে না।

বই হচ্ছে জ্ঞানের বাহক। বই ছাড়া জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। তাই আমাদের বেশি বেশি বই পড়তে হবে। যখন লেখা ছাপার অক্ষরে, বই আকারে প্রকাশিত হয়নি, তখনো জ্ঞানপিপাসু মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে বেরিয়েছে, অর্থ ব্যয় করে জ্ঞানী মানুষদের একসঙ্গে জড়ো করে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছে। এখন আর সে প্রয়োজন নেই। মানুষ তারলব্ধ জ্ঞান যুগ যুগ ধরে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে বিপুল জ্ঞানের আধার লাইব্রেরি। তবে মানুষ যেমন খাবারের জন্য বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকার জন্যই খায়, তেমনি মানুষ বই পড়ার জন্য বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকার জন্য বই পড়ে। কাজেই বেশি করে বই পড়তে হবে।

মজার একটা বিষয় অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। অনেক বাবা-মায়ের ধারণা, ছাত্রাবস্থায়, বিশেষত বিদ্যালয় ও কলেজে পাঠরত অবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ে ছেলেমেয়েরা অযথা সময় নষ্ট করে। তার চেয়ে যদি ওই সময় পাঠ্য বিষয়ে পড়াশোনা করে, তবে পরীক্ষার ফলাফল যা করেছে, এর চেয়ে আরও ভালো করত পারত। এ ধারণা ১০০ ভাগই ভ্রান্ত। অনুর্বর মাটির সঙ্গে সার মিশে গিয়ে যেমন জমিকে অলক্ষ্যে উর্বর করে, তেমনি শিশুমনেও পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়া ভবিষ্যতে তাদের চিন্তাচেতনা ও মননে সুস্পষ্ট ছাপ রাখে। আমরা যদি মনে করি, পাঠ্যপুস্তক নিরেট সাদা ভাতের মতো আর এর সঙ্গে পাঠ্য বিষয়-বহির্ভূত বিভিন্ন প্রকার বই বিভিন্ন প্রকার মজাদার ব্যঞ্জনের মতো খাবারকে সুপাচ্য উপাদেয় করে তোলে। তাই বুঝতে পারা যায় যে, পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি কেন অন্য বইয়ের প্রয়োজন রয়েছে।

বেশ আগে খবরের কাগজে দেখেছিলাম, ভেনেজুয়েলার বামপন্থী রাষ্ট্রনায়ক হুগো চাভেজ তাঁর দেশে ‘পাঠবিপ্লব’ শুরু করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে একটি বাম বিপ্লবাত্মক বইও উপহার দিয়ে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বারাক ওবামাকে তিনি যে বইটি উপহার দিয়েছেন, তা এডুয়ার্ডো গ্যালিয়ানোর একটি বিখ্যাত বাম বিপ্লব ক্ল্যাসিক। হুগো চাভেজ বেশ আগে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত এক ভাষণে তাঁর দেশের জনগণকে পাঠে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বিপ্লবে, ভাষণে নির্দিষ্ট করে একটি স্লোগান জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তা হলো ‘পাঠ’ এবং ‘পাঠ’। এত দিন বিশ্বনেতারা তাঁদের জনগণকে কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন, কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো নেতা জনগণকে পড়াশোনার নির্দেশ দিয়েছেন, তা-ও আবার সরাসরি প্রচারিত ভাষণে—এমনটা বিশ্ব আর কখনো অবলোকন করেনি। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠবিপ্লব খুবই প্রয়োজন। সেই স্বপ্ন দেখি।

আমাদের দেশে বই কেনা নিয়ে অনীহা আছে। আমরা বই না কিনে ধার করি। বই কেনা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর আইকনিক সেই লেখার পর কত দীর্ঘ সময় চলে গেল, কিন্তু তাঁর আক্ষেপ জারি থাকল। ‘বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলিয়া হয় না,’ তিনি লিখেছিলেন। খাঁটি কথা, কিন্তু বাঙালি এখন বালিশ-কাণ্ডে হাত পাকিয়েছে, ব্যাংক লুট করতে শিখেছে, উপরি পাওনায় অভ্যস্ত হয়েছে। সে নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে দেউলিয়া করে। আর তাকে বই কিনতে বললে জানাবে, ‘অত কাঁচা পয়সা কোথায় যে বই কিনব?’ আক্ষেপটা যৌক্তিক। পয়সা এখন শুধু কাঁচা নেই, বেগমপাড়ায়, বিটকয়েনে, ছায়াচ্ছন্ন নানা ব্যবসায় সুপার কাঁচা; অর্থাৎ পাকা আসন পেতে নিচ্ছে। আর আমার-আপনার মতো যাঁরা মাসান্তে মাইনের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকি, তাঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া গিন্নির বাজার-ফর্দ অর্ধেকটা কাটা পড়ার আগেই ওই টাকা কেটে পড়ে। প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় ওমর খৈয়ামের কথা জেনেছি। তিনি বলেছিলেন,  ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা—যদি তেমন বই হয়।’

পৃথিবীর অনেক দেশে লাইব্রেরির জন্য আলাদা মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়, এমনকি পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও একজন লাইব্রেরিমন্ত্রী রয়েছেন। আমাদের দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় লাইব্রেরিগুলো দেখভাল করে; অথচ মজার ব্যাপার হলো, এই মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। এই অবহেলিত লাইব্রেরিগুলোকে ঢেলে সাজানোর কোনো মাস্টারপ্ল্যান ও দেখছি না। টেকনোলজি ড্রাইবেন সেঞ্চুরিতে ভালো, রুচিশীল গ্রন্থাগার আর মনোযোগী পাঠক কি হারিয়ে যাবে? না। আমরা হারাতে পারি না। আমরা আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ধরে রাখতে চাইছি। এ লক্ষ্যে আমাদের প্রতিটি লাইব্রেরি বিশ্বসাহিত্যের নামীদামি বইয়ে পরিপূর্ণ করা হোক। রূপান্তরিত করা হোক একেকটি সমৃদ্ধিশালী লাইব্রেরি। তখন আমরা বলতে পারব যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানের অঙ্কিত মানুষ, কাঙ্ক্ষিত মানুষ তৈরি করা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব।

রোমান দার্শনিক  সিসেরো বলেছিলেন, ‘বাড়িতে একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করার মানে হচ্ছে বাড়িটিতে প্রাণের যোগ ঘটানো। তাহলে প্রতিটি বাড়িতে পাঠাগার গড়ে তোলা মানে নতুন একটি প্রাণ সৃষ্টি করা। তিনি আরও বলেছিলেন, যদি তোমার একটি বাগান ও একটি গ্রন্থাগার থাকে, তবে প্রয়োজনীয় সবই তোমার আছে। আমাদের গর্ব একুশে পদকজয়ী জিয়াউল হক কতই-না কষ্ট করে গড়ে তুলেছিলেন একটি পাঠাগার। ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়ির একটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার। এ পাঠাগারে এখন ১৪ হাজার বই আছে বলে জানান তিনি। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইও আছে পাঠাগারে। সব বই রাখার স্থান না হওয়ায় সেই বইগুলো আছে পাশের মুসরিভূজা ইউসুফ আলী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠাগারে। মনে আছে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেছিলেন, একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। আসুন, বদলে দিই এই পৃথিবী।

লেখক: বদরুল আলম, প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, সিলেট।