ফুলবাড়িয়ায় মানুষের ঢল হুমগুটিতে, এ খেলা কেন খেলেন মানুষ
কনকনে ঠান্ডায় হিমেল হাওয়া আর কুয়াশার চাদর কেটে পৌষের শেষ বিকেলে তখন একচিলতে রোদের দেখা মিলল লক্ষ্মীপুরের বড়ইআটা গ্রামে। চারপাশে ঠাকঢোল, মানুষের চিৎকার আর উল্লাস দেখে আমোদিত তখন গাছপালা, লতাগুল্ম, পাখিরাও। পাখির চোখে দেখলে মনে হতে পারে ভাগীরথী নদীর পাড়ে পলাশীর ময়দানে লর্ড ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে লড়ছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যবহর। একদম নয়, বরং মানবজমিনে হাজারো মানুষের এ ঢল খেলাকে ঘিরে। প্রায় ৩০ কেজি ওজনের পিতলের বৃত্তাকৃতির বলকে নিয়ে যত লড়াই, হুমড়ি খেয়ে ‘জিতই আবা হেইয়ো বলে ঝাঁপিয়ে পড়া’—এই কাড়াকাড়ি খোলার নাম হুমগুটি খেলা।
দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আঞ্চলিকভাবে এখনো রয়েছে নানা খেলার চল। সে রকমই শতাব্দীর প্রাচীন একটি খেলা, যা পৌষ মাসের শেষদিন গত শনিবার ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় দুপুরে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ইআটা বিলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৬৫তম এ আসরে ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকাজুড়ে বয়ে যায় উৎসবের আমেজ। ১৭৫৮ সালে প্রথম এ খেলাটি শুরু করেন, স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দৌলত মণ্ডল। হুমগুটি স্মৃতি সংসদের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক জানালের হুমগুটি খেলার ইতিহাসটাও।
আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, দৌলত মণ্ডল এ খেলার প্রতিষ্ঠাতা, জমিদার আমল থেকে বংশপরম্পরায় আমরা এখনো নতুন প্রজন্মের জন্য হুমগুটি খেলার প্রচলন করে আসছি। হুমগুটি এ অঞ্চলের আঞ্চলিক সামাজিক বিনোদন কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের আশা, সরকার যেন এ খেলাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে খেলাটি টিকিয়ে রাখেন নতুন প্রজন্মের জন্য।
খেলাকে ঘিরে বাড়ি বাড়ি চলতে থাকে উৎসব, পিঠাপুলি মাছ মাংস রান্না হয় বাড়িতে। খেলার দিন তাই একটু ভালো মন্দ খাওয়ার রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত বাড়ির গৃহিণীরা, স্বজনদের সঙ্গে দেখা হয় বলেও আনন্দটা যেন একটু বেশিই থাকে বাড়ি ভরা।
পোলাও কোর্মার ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায় পুরো এলাকাজুড়ে। পাড়ায় জবাই হয় গরু। বাড়িতে আসবে মেয়ের জামাই, তাই পালের মোরগটাকে খোয়ার থেকে বের করেই গলায় ছুড়ি চালানো হয়েছে সকাল সকাল। নতুন আলুতে খুব যত্নে দেশি মুরগির ঝোল রাঁধছেন চাচি, মা, খালারা। সঙ্গে অল্প তেলে আতপ চালের পোলাও হয়েছে। বাটা লাল মরিচে তেল ভাসানো ঝাল ঝাল গরুর মাংসও আছে। ঘরে ঘরে চলছে পিঠাপুলির ধুম। নতুন খেজুর গুড়ের ভাপা, পায়েসও।
বাড়তি আনন্দ যোগ করে বাচ্চারা, নতুন জামাকাপড় পরে সেজেগুজে এদিক–ওদিক ছুটাছুটি করে। ঘরের নতুন বউ পুরোনো শাড়ি পাল্টে পরেন নতুন পাটভাঙা শাড়ি। চোখে হালকা কাজল মেখে ঠোঁটে পরেছে অল্প করে লিপস্টিক। ঘোমটা টেনে লাজুক লাজুক হাসিতে দৌড়ে দৌড়ে ঘরের কাজ সামলাচ্ছেন। বাড়িভরা নাইওরিতে গমগম করে। ধান কেটে ফেলার পর খোলা মাঠে মেলা বসেছে। বসেছে মুড়ি–মুড়কির দোকান। ভাজা হচ্ছে গরম–গরম জিলাপি। আরও আছে বাচ্চাদের হরেক খেলনা। পুরো এলাকায় যেন এক সাজ সাজ আমেজ।
পৌষের শেষ দিন। দিনকে আমার এলাকায় আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘পুহুরা’। ২৬৪ বছর ধরে চলে আসা এক আজব খেলা অনুষ্ঠিত হয় এ দিনে। এ নিয়ে ২৬৫ বছরে পা রাখল খেলাটি। খেলাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় চলে ঈদের আমেজ, অনেকে আনন্দ করে বলেন, এ গ্রামে ঈদ আসে ৩ বার।
এই খেলায় নেই কোনো নিয়মকানুন, থাকে না কোনো রেফারি, বিচারক। খেলায়াড়েরও কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। ৪০ কেজি ওজনের এক পিতলের বলকে বলা হয় গুটি। আর এই গুটি টানাটানিই হলো খেলা। টেনেহিঁচড়ে কাড়াকাড়ি করে যে বা যাঁরা এই গুটি গুম করে ফেলতে পারবেন, তাঁরাই বিজয়ী। খেলার সুবিধার্থে গুটির ওজন করা হয়েছে এখন ৩০ কেজি।
এলাকার নির্দিষ্ট একটা জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত খেলোয়াড়রা নিজের এলাকার হয়ে লড়তে আসেন। মাথায় বাঁধা ফিতায় লেখা থাকে নিজ নিজ এলাকার নাম। খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে পাশে থাকেন তাঁদের এলাকার চেয়ারম্যান। গরু জবাই করে গ্রামসুদ্ধ লোককে খাইয়ে চেয়ারম্যান খেলোয়ারদের মাঠে পাঠান নিজ এলাকার মান রক্ষা করতে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ‘হুমগুটি’ খেলায় ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সকাল থেকে দল বেঁধে শত শত খেলোয়াড় খেলার কেন্দ্রস্থল তেলিগ্রাম বড়ইআটা গ্রামে আসেন। সন্ধ্যায় খেলায় লাখো মানুষের ঢল নামে। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় খেলাটি চলছিল পার্শ্ববর্তী দশমাইল গ্রামে।
রোববার দুপুরে ঐতিহ্যবাহী ‘হুমগুটি খেলার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদ সদস্য মো. আবদুল মালেক সরকার। এ সময় বালিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান পলাশ, খেলার আয়োজক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধন শেষে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে প্রায় ৩০ কেজি ওজনের হুমগুটি মুক্তাগাছা জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের সীমানা তেলিগ্রাম বড়ইআটা গ্রামে ধানের পতিত জমিতে হাজারো খেলোয়াড়দের মধ্যে ছেড়ে দিলে ‘হুমগুটি’ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। খেলোয়াড়েরা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ চার ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলতে শুরু করেন।
সকাল থেকে ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল ও ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের তালে শত শত খেলোয়াড়রা আসেন। সন্ধ্যায়ও দেখা যায় শত শত খেলোয়াড় আসছেন খেলতে। গুটি খেলাকে কেন্দ্র করে পৌষ মেলা বসেছিল তেলিগ্রাম বড়ইআটা গ্রামে। গ্রামে গ্রামে চলে উৎসবের আমেজ। দেওখোলা, তেলিগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, বড়ইহাটা, ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, শুভরিয়া, কালিবাজাইল, দশমাইল, কুকরাইল, কাটাখালী, মোহাম্মদনগরসহ আশপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের মিলনমেলা হয়।
জনশ্রুতি আছে মুক্তাগাছা জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপের বিরোধ সমাধানে তাঁদের প্রজাদের মধ্যে কৌশল ও শক্তির খেলা ‘হুমগুটি’র আয়োজন করেছিলেন। খেলার শর্ত ছিল যে জমিদারের প্রজারা ‘হুমগুটি’ নিতে পারবেন, সেই জমিদারের জমির পরিমাপ হবে সাড়ে ৬ শতাংশে ১ কাঠা। পরাজিত জমিদারের এলাকার জমির পরিমাপ হবে ১০ শতাংশে ১ কাঠা।
জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী প্রজারা খেলায় বিজয়ী হয়। এর পর থেকে জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর ‘পরগনা’ এলাকায় জমির পরিমাপ হয় সাড়ে ৬ শতাংশে ১ কাঠা। জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের এলাকা ‘তালুক’ জমির পরিমাপ হয় ১০ শতাংশে ১ কাঠা।
‘হুমগুটি’ স্মৃতি সংসদের পরিচালক এ বি সিদ্দিক আরও বলেন, খেলার মাধ্যমে দুই জমিদারের জমির পরিমাপ বিরোধ সমাধান হয়েছিল। পূর্বপুরুষরা প্রতিবছর পৌষ মাসের শেষ দিন খেলাটি আয়োজন করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় আমরা যুগ যুগ ধরে খেলাটির আয়োজন করে আসছি। হুমগুটি খেলায় নির্দিষ্ট কোনো সময় ও খেলোয়াড়ের সংখ্যা নেই। খেলার কোনো পরিচালনাকারীও নেই। তিনি দাবি করেন, এবার ২৬৫তম বছর হলো এ খেলাটির।
এবার হুমগুটি খেলার বিজয়ী দল ত্রিশাল উপজেলার দানিখোলা ইউনিয়ন। হুমগুটি খেলা বেঁচে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম—এমনটাই প্রত্যাশা এই জনপদের মানুষের।