আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বহিরাগত’ ভাইরাস
আপনাকে যদি প্রশ্ন করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়? উত্তরে বিদ্বৎসমাজের একজন হয়ে আপনি হয়তো ঘরোয়া ঘরানার কিছু একটা বলে দেবেন। কিন্তু মশাই থামেন, এখানেই অন্ত না। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সব পাবলিক’ অবাধে আনাগোনা-আড্ডাবাজি, যাতায়াত-জমায়েত, সভা-মিটিং-মিছিল, হইচই-রইরই, পার্কিং-মার্কেটিং-পিকেটিং করতে পারে, সেটাকেই যদি আমি বলি ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’? কেন আমার এ রকম হাট্টিমাটিম টিম প্রকৃতির সংজ্ঞায়ন, তা একটু পরই জলবৎ স্পষ্ট হয়ে যাবে।
এই ধরুন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর বিশাল আলেখ্যে জগতের জন্য ইংলিশ কবি পি বি শেলি ও লর্ড বায়রনের সঙ্গে তুলনা করে ‘বাংলার বায়রন’ ও ‘বাংলার শেলি’ বলা হয়। মহাকবি ফেরদৌসীকে গ্রিক কবি হোমারের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয় ‘প্রাচ্যের হোমার’। বিখ্যাত মুসলিম চিত্রশিল্পী কামালউদ্দিন বিহাযাদকে রেনেসাঁ যুগের বিশ্বখ্যাত ইতালীয় চিত্রশিল্পী রাফায়েলের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয় ‘প্রাচ্যের রাফায়েল’। হাজার রকমের গাঁইগুঁই থাকলেও ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে মিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলতে অনেকেই স্বস্তি বোধ করেন। দিন শেষে শিক্ষকেরা ছাত্রদের, মা–বাবা সন্তানদের, ভার্সিটির বড় ভাইয়েরা জুনিয়রদের বলে থাকেন ‘বাবা সর্বান্তকরণে চেষ্টা করো, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের পথ ধরো’। কিন্তু সেই স্বস্তির খানিকটুকুও কি আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুভব করতে পারছেন?
হাজারটা সমস্যার ভিড়ে যে সমস্যাটি বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে প্রকট, তা হলো ‘বহিরাগতদের উৎপাত’। যাঁদের কিছুক্ষণ আগে ‘পাবলিক’ অভিধায় ডাকা হলো। তাঁরা সপ্তাহের প্রতিটা দিন ঘুরছেন, ফিরছেন, খাচ্ছেন, বার্থডে সেলিব্রেশন করতে আসেন, হ্যাঙ্গআউট করতে আসেন, টিএসসির চা, ফুল, ফুচকা খেতে বা কিনতে আসেন, কেউবা আসেন সপরিবার দিনব্যাপী ভ্রমণে, কেউবা আসেন কার্জনে-টিএসসিতে ফটোসেশনে, কেউবা নিজেদের প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন তৈরি করতে (কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া), কেউ কেউ তো ১০ টাকায় চা-চপ-সিঙ্গারা ত্রি–অমৃতের শ্রীমুখ দর্শনেও আসেন। বহিরাগতদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার-বসার কারণ যেমন হাজারটা, এর সমস্যাও সমানুপাতিক।
ধরেন, খুব ঠান্ডা একটা মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। তখনি ফোনে কল দিয়ে আপনার গ্রামের কোনো এক বন্ধু বলল, ‘মামা তোমার বাচ্চার মা কই?’ আপনি কিছু বুঝলেনও না। একটু পর খবর পেলেন টিএসসিতে কোনো একটি ডাস্টবিনে সদ্য নবজাতকের মরদেহ পাওয়া গেছে। এবার আপনি বুঝলেন, আপনার ওই বন্ধু টিটকারি মেরে আপনাকেই ওই নবজাতকের পিতৃ পরিচয়ে সম্ভাষিত করেছে। কেমন লাগবে? ঠিক এমনই মাঝেমধ্যে শুনতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আবাসিক ভবন শেখ রাসেল টাওয়ারের বিপরীতে ডাস্টবিন থেকে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে টিএসসি–সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় পরিত্যক্ত একটি বাক্স থেকে কাপড়ে মোড়ানো দুই নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। সঠিক তদন্ত করলে দেখা যাবে, এগুলো ক্যাম্পাসে বহিরাগতদেরই কর্মকাণ্ড। ব্যাপারটা এমন, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে।
একটা খুব সাধারণ সমীকরণ বুঝতে হবে। যেখানে বেশি মানুষের জমায়েত হবে, সেখানে তো যানবাহনও মাত্রাতিরিক্ত হবে। ওই সব মানুষের জন্য ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বসবে, শৌখিন জিনিসের হরদম চলবে, এটাই স্বাভাবিক। আর ঠিক হয়েছেও তা–ই। আর এর ভিড়ে হাজারটা অপকর্মও চলবে। ধরেন, আপনি সেমিস্টার পরীক্ষার ফি’র টাকা খুব মানবেতর সুলুকে জোগাড় করলেন। টাকাটা পকেটে নিয়ে একবুক স্বপ্ন জিইয়ে টিএসসি পার হতেই পকেট থেকে ফাঁকা। এ রকম ‘পিক পকেটের’ স্বীকার হন শত শত শিক্ষার্থী। নারী শিক্ষার্থীরা তো এই ভয়ে সন্ধ্যা নামলে হাঁটতেও ভয় পান। কখনো কখনো অপ্রীতিকর সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কেউ কেউ তো মানসিক ট্রমায় ভুগতে থাকেন। এরও কোনো প্রতিকার নেই। কারও কি বিশেষ দৃষ্টিপাত আছে এ সমস্যার ওপরে?
বহিরাগত সমস্যার আরেকটা ‘বাইপ্রোডাক্ট’ হচ্ছে অবৈধ ও অস্থানে গাড়ি পার্কিং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা মোড়ে মোড়ে তাকালে দেখা যায়, বাহারি রকমের গাড়ি পার্কিং করা। দেখলে মনে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই বুঝি ‘ক্যাপিটালিস্ট’ কিংবা ‘পিটি বুর্জেয়া’ হয়ে গেলেন। আসলে এর কোনোটাই নয়। বহিরাগতদের গাড়িগুলো এতই বেপরোয়াভাবে পার্কিং করা হয় যে যেখানে–সেখানে যানজট লেগে যায়। আর এর সর্বৈব ভোগান্তি পোহাতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এর শেষ কোথায়? নাকি আমরা বলব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও বটে? কারণ, প্রাইভেট কার আর প্রাইভেট কার!
বিশ্বে প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। আর এর মধ্যে বাংলাদেশে এর হার সর্বাধিক, ২৮ শতাংশ। চিন্তা করা যায়! অবস্থা যখন ঠিক এ রকম বেহাল, তখনই ঢাকা শহরের হারটা কত হবে তা সহজেই অনুমেয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে আজকাল এত পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা, পচা খাবার পরে থাকে যে নাভিশ্বাস ওঠে। বহিরাগতদের খাবারের প্যাকেট, বাচ্চাদের ডায়াপার, প্লাস্টিকজাত দ্রব্য, মলমূত্র ইত্যাদি। এই বর্জ্য কখনো কখনো দীর্ঘদিন অপসারণ না করার কারণে হয়ে ওঠে অমোঘ মারণাস্ত্র। জীবাণু থেকে ছড়ায় নানাবিধ রোগশোক বালাই। ভুগতে হয় দিনের পর দিন। এর শেষ কোথায়?
যদি অভয় পাই, বিসমিল্লাহ বলে শুরু করি!
ক্যাম্পাসে মাদক সেবনকারীদের আস্তানার শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে ছিনতাইকারীদের পাঁয়তারার শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে শুক্রবারে হাট/মেলার শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে কান ঝালাপালা করা শব্দদূষণের শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে কার্জন হলে বহিরাগতদের অপ্রীতিকর কর্মের শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বহিরাগতের অনুপ্রবেশের শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে আমার ছাত্রী বোনের ‘নিরাপদ মনে না করার’ শেষ কোথায়?
ক্যাম্পাসে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ রফাদফার শেষ কোথায়?
শেষটা কোথায়, দাঁড়ি কোথায়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা বলেই বিবেচিত হবে আমার ধারণা। জাতির সবচেয়ে মেধাবী আর সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান, কিন্তু এই আপনাদের অবিবেচকের মতো আমাদের ক্যাম্পাসে এসে আমাদের পড়ার পরিবেশ ‘ফিশ আউট অব ওয়াটার’ করার কারণে আমরা কষ্টে আছি। সারা দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় আমরা পড়াশোনা করি, আপনারা নাহয় আরেকটু করেন আমাদের জন্য। পড়ার পরিবেশ তৈরি করে দেন। দয়া করে কাশ্মীর যান, গয়া–কাশী–বৃন্দাবন যান। দরকার হলে ইউরোপের আল্পস কিংবা এশিয়ার হিমালয়ে ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে। এখানে আসবেন না দয়া করে। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিকদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নয়।
*লেখক: নাবিল হাসান, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়