এখন পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার মধ্যে চলেন, যেমন সারা জীবন চলেছেন

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ‘নাগরিক সংবাদ’-এ।

রূপেন কুমার দাশ
ছবি: সংগৃহীত

পরম শ্রদ্বেয় রূপেন স্যার। পুরো নাম রূপেন কুমার দাশ। ছিলেন আমাদের রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষা-শাসন বারণ ন্যায়নিষ্ঠায় অনন্য ও পরম শ্রদ্বেয়। বছর কয়েক স্যারের ঘরেও পড়েছিলাম আমরা। মারাত্মক তটস্থ না থাকলেও ভয় পেতাম বটে। পড়া শেখা লেখা, পারা বা না–পারার মাত্রা অনুযায়ী ছিল সাজার ধরন, বেতের সাইজও সেই অনুযায়ী সাজানো ছিল। মাসিমা (প্রয়াত) অর্থাৎ স্যারের স্ত্রী প্রায়ই পরম মমতায় আমাদের উদ্ধার করতেন পড়া না পারার সাজা থেকে। বছরখানেক আগে মাসিমা পাড়ি জমালেন না–ফেরার দেশে।

পার্বত্য রাঙামাটির মফস্‌সল এ শহরে, কমবেশি সবাই সবার চেনাজানা। আমাদের বাসা প্রায় কাছাকাছি এলাকায় হওয়ায় আমার বাবা জেঠা পরিবার–পরিজনের সঙ্গে স্যারের চেনাজানাও ছিল বেশ ভালো।

প্রায় পাঁচ কাকাতো-জেঠতুতো ভাই একই স্কুলেই পড়তাম, স্যারের অনুশাসনেই ছিলাম।

বাবা ছিলেন শিল্প–সংস্কৃতির মানুষ, স্বভাবতই বাবার সঙ্গে স্যারের আলাপচারিতা, পরিবার পর্যায়ের ভাব বিনিময় ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ।

রূপেন স্যার আমাদের স্কাউট শিক্ষকও ছিলেন। স্যারের সঙ্গে থেকেই কাব, স্কাউট করেছি। স্কুল তথা পুরো রাঙামাটিতেই স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের স্কুলের স্কাউটিং অনেক সমৃদ্ধ ছিল।

খুব করে একটা বিষয় মনে পড়তেই বেশ আপ্লুত হই বরাবরই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়ামে ১৯৯৭ সালের ৩ থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ দিনব্যাপী ১৫তম চট্টগ্রাম আঞ্চলিক স্কাউট সমাবেশে স্কুল থেকে স্যারের নেতৃত্ব আমরা অংশগ্রহণ করি।

ভেন্যুতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই স্যার আমাদের ছাত্রদের সবার শারীরিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে, যার যার ঘর থেকে দেওয়া হাতখরচের টাকা স্যারের কাছে নিয়ে নেন, যাতে আমরা কেউ এই ৪ দিনে অস্বাস্থ্যকর এটা–সেটা খেয়ে নিজেদের শরীর/পেট খারাপ করে না ফেলি।

টিমে আমার সিনিয়র, জুনিয়র সবাই যার যার হাতখরচের টাকা একে একে স্যারের হাতে তুলে দিলেও, আমার টাকা আমি দিইনি, এবং বলেছি বাবা কোনো হাতখরচ দেননি। স্যারের সঙ্গে যেহেতু বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, আমাদের একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে জানে বাবার সংগ্রামের কথা, সে হিসাবে স্যার আমার কথাটা বিশ্বাস করলেনও বটে।

আর এ সুযোগে ছোটবেলা থেকেই মিষ্টিপ্রিয় আমি, বাবার দেওয়া তৎকালের ৩০০ টাকা দিয়ে মিষ্টির জন্য বিখ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ভালো মিষ্টির দোকানে খেলাম নানান পদের মিষ্টি।

চলে আসার দিন স্যার সবার টাকা ফেরত দিলেন যে যার মতো কিছু কেনার জন্য, এবং দুই কেজি ওজনের মিষ্টির প্যাকেট স্যার আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘ধর এগুলো, ঘরের সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে খাবি।’ পরে বাবার কাছ থেকে সঠিকটা জানার পর অবশ্য আমাকে কিছু বলেননি, বাবা মিষ্টির টাকা দিতে চাইলেও স্যার তা নেননি। মিষ্টির প্রতি লোভের কারণে স্যারকে সে সময় মিথ্যা বললেও, স্যারের সে সময়ের শিক্ষক পরিচয় ছাপিয়ে পিতৃত্বসুলভ স্নেহ আজও আমায় আবেগপ্রবণ করে তোলে।

পরবর্তী সময়ে স্যার রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামে বদলি হলেন। এখন স্যারের অবসরকালীন জীবন।

কিছুদিন মাসিমার অসুস্থতায় ও পরবর্তী সময়ে মাসিমা মারা যাওয়ার পর অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন।

চট্টগ্রামে স্যারের সঙ্গে যেখানেই দেখা হয়, পায়ে ধরে প্রণাম করতেই পিতার স্নেহে কুশল বিনিময় করেন প্রতিবারই। ২০১১ সালে বাবা যখন প্রথম স্ট্রোক করে প্রায় ৩ মাসের মতো চট্টগ্রামে ছিলেন, স্যার বেশ কয়েকবার বাবাকে দেখে গেছেন, সময় কাটিয়েছেন। ২০১৩–তে বাবা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে স্যার মর্মাহত হয়েছিলেন খুব।

বর্তমানে স্যার চট্টগ্রাম শহরে তাঁর বড় মেয়ে অপর্ণার সঙ্গেই আছেন। স্যারের বড় মেয়ের বর সুমনদা আমার সহকর্মী, বেশ চেনাজানা। স্যারের খবরাখবর জানতে চাইলে সুমনদা থেকেই জানি। নাতি–নাতনি, ছাদবাগান, ভ্রমণ...এসবেই কাটছে স্যারের নিত্যদিন। এখনো সেই পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার মধ্যে পরিপাটি করেই নাকি চলেন, যেমনটা সারা জীবন চলে এসেছেন।

স্যারের কাছে যেমন শাসন-স্নেহ দুটোই দেখেছি, আমরাও দুরন্ত ছিলাম বটে, কিন্তু কখনো আগ্রাসী ছিলাম না। সম্পর্কটা শিক্ষক, ছাত্র, বিদ্যালয়, বইপুস্তক শুধু এসবেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল এবং আছে পরম শ্রদ্ধা-স্নেহ–মমতা ও সম্মানের। শ্রদ্ধেয় রূপেন স্যারের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা নিরন্তর।

**লিখতে পারবেন আপনিও। লেখার শিরোনামের ওপর ‘শিক্ষক দিবসের লেখা’ শব্দটি লিখবেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]