বৈসু ও গরিয়া নৃত্য: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত অন্যতম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হলো ত্রিপুরা। এই জনগোষ্ঠীর হাজার বছর ধরে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও উৎসব রয়েছে, যা জাতিগত পরিচয়ের অন্যতম বাহক। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন বিশ্বায়ন, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা একদিকে মানুষের জীবনযাত্রায় নতুন গতি এনেছে, অন্যদিকে তা নানা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচয়কে বিপন্ন করে তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাণবন্ত উৎসব হলো বৈসু, যা বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিকে উদ্যাপন করা হয়।
চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন—তিন দিনব্যাপী এ উৎসব পালন করা হয়। প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসি কাতাল। মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। তিন দিনব্যাপী এই বৈসুর প্রথম দিন হারি বৈসু। হারি বৈসুতে ভোরবেলায় ফুল গাছ থেকে ফুল তোলার প্রতিযোগিতা চলে। সেই ফুল দিয়ে বাড়ি সাজানো হয় এবং পাশাপাশি সেই ফুল মন্দির এবং পবিত্র স্থানে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বৈসু উৎসবের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হলো গরিয়া নৃত্য। এই উৎসব ও নৃত্য কেবল আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সামাজিক ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আত্মপরিচয়ের অন্যতম ভিত্তি।
‘বৈসু’ শব্দটি এসেছে ‘বৈশাখ’ মাস থেকে, যার অর্থ বাংলা নববর্ষের সূচনাকাল। এটি মূলত নতুন বছরের আগমন, ফসল কাটা শেষ হওয়ার আনন্দ এবং গরিয়া দেবতার পূজার এক মহা উৎসব। বৈসুর সময় পরিবার, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন—সবাই একত্র হয়ে গরিয়া দেবতার পূজা করেন। দেবতাকে আহ্বান করে গ্রামের সব মানুষের কল্যাণ, সুখ-সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা কামনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, গরিয়া দেবতা ফলপ্রসূতা, সুস্থতা ও সমৃদ্ধির দেবতা। তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করা মানেই আগামী বছর হবে শুভ ও কল্যাণময়। উৎসবটি সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত উদ্যাপিত হয়। এ সময় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলে বিশেষ রান্নাবান্না, নৃত্য, গান, খেলাধুলা ও সামাজিক মিলনমেলা। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে গরিয়া নৃত্যে অংশ নেন। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চিত্ররূপময় অনুষঙ্গ হলো গরিয়া নৃত্য। এই নৃত্য শুধু একটি নৃত্যধারা নয়; বরং এটি একটি ধর্মীয় আচার, সামাজিক অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সমন্বিত রূপ।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
‘গরিয়া নৃত্যে ২২ তাল’; অর্থাৎ এই নৃত্যে ২২টি ভিন্ন ভিন্ন ছন্দ, ভঙ্গি, তাল ও গতিরূপ রয়েছে, যা গরিয়া দেবতার পূজা থেকে শুরু করে তাঁর বিদায় পর্যন্ত প্রতিফলিত করে। নৃত্যটি শুরু হয় গরিয়া দেবতাকে আহ্বান করার মাধ্যমে, এরপর ধাপে ধাপে চলে তাঁর অর্চনা, কীর্তন, আশীর্বাদ প্রার্থনা, উৎসব উদ্যাপন এবং শেষে বিদায় অনুষ্ঠান। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো নৃত্যকারদের পোশাক ও সজ্জা। তাঁরা রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন, নারীরা গা–ভর্তি গয়না পরে নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি ধাপে থাকে নির্দিষ্ট গান, বাদ্যযন্ত্র (ঢোল ও বাঁশি), দেহভঙ্গিমা এবং চক্রাকারে নাচের ধরন। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক, সহমর্মিতা ও ঐক্য বজায় রাখার অন্যতম পদ্ধতি হলো বৈসু উৎসব। বৈসু উপলক্ষে সব বয়সের মানুষ একত্র হন—ছোট–বড়, নারী–পুরুষ। সবাই মিলে ঘর সাজানো, রান্নাবান্না, অতিথি আপ্যায়ন, নাচগান ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ—এসব মিলেই একটি সামষ্টিক চেতনা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতির বন্ধন দৃঢ় হয়। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার একা নয়—এই বৈসু উৎসব একে অপরের সঙ্গে সামাজিক সংযোগের একটি মোহনা হয়ে ওঠে। যেখানে আধুনিক সমাজে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে, সেখানে বৈসু উৎসব ত্রিপুরা সমাজে মানবিক সম্পর্ক দৃঢ় করে। উৎসবের সময়ে পারিবারিক বিরোধও মিটে যায়, সবাই একত্রে আনন্দে মিলিত হন। এর ফলে একটি শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠে, যা একটি সম্প্রদায়ের টিকে থাকার অন্যতম পূর্বশর্ত। আধুনিক যুগে যেখানে অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি বিলুপ্তির মুখে! ভাষা হারাচ্ছে, পোশাক বদলাচ্ছে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বৈসু উৎসব ও গরিয়া নৃত্য একটি সচেতন সংস্কৃতি সংরক্ষণের হাতিয়ার। ত্রিপুরা সমাজে এই বৈসু উৎসব কেবল প্রাচীন প্রথা পালনের জন্য নয়, বরং নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই উৎসবে: ত্রিপুরা ভাষায় গান গাওয়া হয়, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা হয়, লোকবাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাচ শেখে, গরিয়া পূজার আচার শেখে, গ্রামীণ জীবনের আনন্দময় রূপ প্রত্যক্ষ করে। এভাবেই প্রজন্মান্তরে সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী হওয়ায় নিজস্ব পরিচয় টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখার জন্য আত্মপরিচয়ের চর্চা জরুরি। বৈসু উৎসব সেই আত্মপরিচয়ের চর্চাকে দৃঢ় করে। এই বৈসু উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা অনুভব করেন—ত্রিপুরা একটি জাতি, যাদের নিজস্ব ইতিহাস, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি আছে। এই আত্মপরিচয় যখন নৃত্যে, গানে, উৎসবে ও ঐতিহ্যে প্রকাশ পায়, তখন তা শুধু জনগোষ্ঠী নয়, পুরো দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকেও সমৃদ্ধ করে। এই চেতনা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার প্রেরণা দেয়, এবং বৃহত্তর সমাজে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করে। ‘যদিও বৈসু উৎসব ও গরিয়া নৃত্য’ এখনো ত্রিপুরা সমাজে জীবন্ত আছে, কিন্তু তা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শহরকেন্দ্রিক জীবনধারা, প্রযুক্তির প্রভাবে তরুণসমাজের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। অনেকেই উৎসবকে ‘পুরোনো দিনের ব্যাপার’ বলে অবহেলা করে। এ ছাড়া রয়েছে ভাষা হারানোর ঝুঁকি, লোকশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যসংগ্রহের সংকট।
‘বৈসু উৎসব ও গরিয়া নৃত্য’ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর এক জীবন্ত ইতিহাস, এক স্পন্দিত সংস্কৃতি এবং এক অনন্য আত্মপরিচয়ের রূপ। এটি শুধু একটি উৎসব নয়; বরং একটি আত্মনির্ভর সংস্কৃতিচর্চার আন্দোলন। এই উৎসব আমাদের শেখায়—সংস্কৃতি শুধু অতীত নয়, এটি বর্তমানের প্রাণ এবং ভবিষ্যতের ভিত্তি। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব, এই জাতীয় ঐতিহ্যকে জানানো, মানানো এবং সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা। বৈসু উৎসব ও গরিয়া নৃত্য তাই শুধু ত্রিপুরার নয়, এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি গর্বিত প্রতীক।
লেখক: দহিন ত্রিপুরা, শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়