একটি শিক্ষক সম্মাননা এবং...

প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর শিক্ষাজীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। খুব ভালোভাবে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হলে প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমেই শিশুর মনে দেশপ্রেমের বীজ বোনা, মননে সততা ও নৈতিকতার শেকড় গেঁথে দেওয়া, প্রতিটি শিশুর অন্তরে ভালোবাসার পাহাড় তৈরি করা হয়।

যাঁরা এ কাজের কারিগর, তাঁরা নিঃসন্দেহে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। একজন আদর্শ শিক্ষক যেন বাতিঘরের মতো। আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে আলোকিত করেন শিক্ষার্থীদের। সে আলোয় আলোকিত হয় দেশ। ব্যক্তি–পরিচয় ছাপিয়ে তাঁরা নিজেরাই একটা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। যাপনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করেন শিক্ষকতায়। কর্মজীবনে তাঁর ধ্যানের রাজ্য, তাঁর পৃথিবী শিক্ষকতার নিবিড় পরশে আচ্ছাদিত থাকে।

এই শিক্ষকদের মধ্যে বেশির ভাগেরই ত্যাগ আড়ালেই থেকে যায়। নীরবে-নিভৃতে তাঁরা অবসরে চলে যান। আমাদের নাগরিক ব্যস্ততায় ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে যায় তাঁদের স্মৃতি।

এ বিষয়টি আমলে নিয়ে নিজেই চিন্তা করলাম, আমরাই শুরু করি। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় বোরহানউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বয়স এক শ সাত! এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র ছিলাম। কত স্মৃতি, কত কথা ইথারে মিশে আছে। এই অধম এখন এ স্কুলের সভাপতি। স্কুলের শিক্ষকসহ ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করলাম কীভাবে স্বল্প পরিসরে হলেও চারজন শিক্ষককে সম্মাননা দেওয়া যায়। পাশাপাশি স্কুলের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৭২ শিক্ষার্থীকে উদ্দীপনামূলক পুরস্কার দেওয়া যায়। প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার আপা বলেন, ‘উদ্যোগ তো ভালো কিন্তু অর্থ পাব কোথায়?’ তাঁকে আশ্বস্থ করা হলো আমরা সম্মিলিতভাবে করে ফেলব। ভালো কাজ টাকার অভাবে থেমে থাকে না।

এটা মাথায় নিয়ে আমাদের সাবেক শিক্ষকেরা যাঁরা বেঁচে আছেন এবং যাঁরা এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের পরিবারকে স্বল্প পরিসরে হলেও একটু স্মরণ করার সিদ্ধান্ত। আমরা নির্বাচন করলাম, বোরহানউদ্দিনে শিক্ষকদের আইকন প্রয়াত মফিজুল ইসলাম স্যারের পরিবার, প্রয়াত গণি স্যারের পরিবার, আবদুল অদুদ স্যার, আবদুল হক স্যারকে সম্মাননা প্রদানের।

২৩ জুলাই, রোববার। বোরহানউদ্দিন পৌরসভার হলরুম কানায় কানায় পরিপূর্ণ। প্রধান অতিথি পৌর মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম। প্রসঙ্গত, অনুষ্ঠান সফল করতে তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

আবদুল অদুদ স্যার ও আবদুল হক স্যার মঞ্চে উঠলেন। সঙ্গে প্রয়াত মফিজুল স্যারের মেজ ছেলে জাকির হোসেন, গণি স্যারের সেজ ছেলে আশরাফ হোসেন। সবাই তাঁদের দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। অনেকে স্যারদের পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া চাইলেন।

মফিজুল ইসলাম স্যার পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০০৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর ছেলে জাকির হোসেন মাইক্রোফোনে বাবাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেন। আবেগে তাঁর গলা ভারী হয়ে গেল। সবার কাছে দোয়া চেয়ে বিদায় নিলেন। গণি স্যার চলে গেছেন ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর। তাঁর ছেলে আশরাফ হোসেন মাইক্রোফোন নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন।

আবদুল অদুদ স্যার প্রাথমিক শিক্ষার একাল-সেকাল তুলে ধরলেন। বললেন, এ বিদ্যালয় থেকে অবসরে যাওয়ার পর এই প্রথম কেউ তাঁকে আমন্ত্রণ জানাল, সম্মান জানাল। সাবেক ছাত্রদের থেকে এ সম্মান পাওয়া মানে হচ্ছে শিক্ষক–জীবন স্বার্থক।

আবদুল হক স্যার তাঁর স্মৃতিকথা শোনালেন। তিনি সাবেক শিক্ষকদের স্মরণ করা, সম্মাননা প্রদানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আমার ছাত্ররা আজ আমাকে সংবর্ধিত করছে এর চেয়ে বড় পাওয়ার আর কী আছে!’

প্রধান অতিথি পৌর মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম স্যারদের সম্মান জানিয়ে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

স্যারদের আমরা কী-ই বা দিলাম। একটা সম্মাননা স্মারক, একটা অভিনন্দনপত্র। আহা তাঁরা কত খুশি! আমরা যে তাঁদের স্মরণ করেছি, তাতেই তাঁদের চোখে খুশির ঝিলিক ও আনন্দের ঢেউ। এই ঢেউ আমাদেরও ছুঁয়ে গেছে।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা উপহার হিসেবে বই পেয়েও দারুণ খুশি।

  • লেখক: শিক্ষক ও সংগঠক