ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ যেন বইপোকাদের আড্ডাখানা

ক্লাস শেষে হলে ফিরছি। কিছুটা এগোতেই নজর কাড়ল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের সবুজ গালিচায় বসে আছে তারুণের দল। চলছে তাঁদের মধ্যে কথোপকথন। তাঁরা যে এক পাঠচক্রে আগত, সেটুকু আগেই জানা ছিল।

পাঠচক্রটির আলোচনার বিষয় ছিল কলম্বীয় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক গাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেস রচিত ও জি এইচ হাবীব অনূদিত, ‘One Hundred Years of Solitude’ বা ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’।

পাঠচক্র হলো মানুষের ছোট একটি দল, যারা একাধিকবার মিলিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। বই, রাজনীতি, ধর্ম কিংবা শখ—যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করার জন্য পাঠচক্র গঠিত হতে পারে। পাঠচক্রসমূহ ক্লাব থেকে আলাদা। কারণ, দলীয় কিংবা সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করার চেয়ে পাঠচক্রসমূহ একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা বিশ্লেষণে নিবেদিত থাকে।

এমনি একটি পাঠচক্র হলো ‘জেএমএস রিডার্স ফোরাম’। বই থেকে সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ তাঁদের পাঠের বিষয়। লক্ষ্য একটাই—পড়ার অভ্যাস তৈরি করা। জানার জগৎ বিস্তৃত করা। পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষক আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে মুক্ত বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংযোগ স্থাপন, সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট ও চলমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক রূপরেখা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা প্রদান করাই হলো পাঠচক্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

পাঠচক্রটির সদস্য মালিহা খানম আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘গোটা (নিঃসঙ্গতার একশ বছর) বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই এমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এই উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার, কুসংস্কার, জনশ্রুতি, বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা, ফ্যান্টাসি, যৌনাচার ও স্বপ্ন—সবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনো দেখা যায় নি। ১৯৮২ সালে এই উপন্যাসটিই গাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেসকে এনে দেয় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।’

ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগে সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বই। তখন অনেকেরই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস ছিল। অথচ বর্তমানে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে বই পড়ার বিষয়টি খুব কমই চিন্তা করি। তাই ফেসবুকে আসক্ত তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই।

পাঠচক্রের সদস্য ওমর ফারুক আকন্দ বলেন, রিডার্স ফোরামের পাঠচক্রে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে। এতে অংশগ্রহণ করে অনেক কিছু শেখা যায়, অজানা অনেক কিছু জানা যায়। পাঠচক্রের মাধ্যমে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, সুপ্ত প্রতিভা উন্মোচিত হয় ও সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার সক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

পাঠচক্রের আলোচনা কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে যদি এখনো নিশ্চিত না হন, তাহলে এই বিষয়টি আপনাকে আগ্রহী করতে পারে। নিয়মিত পাঠচক্রে অংশ নিলে শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। যেকোনো ধরনের বই শব্দভান্ডার বাড়াতে সহায়ক। আর সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার ভাষার ওপর দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়। ভাষা দক্ষতা নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক। আবার প্রতিদিন বিভিন্ন বই পড়লে কিংবা বিভিন্ন বই সম্পর্কিত তথ্য জানলে নতুন নতুন ভাষা শেখা যায়।

নিয়মিত পাঠাভ্যাস চিন্তার দক্ষতা বিকাশে ভূমিকা রাখে। আর চিন্তার দক্ষতা উন্নত হলে যেকোনো সমস্যা সমাধান সহজ হয়। আবার কোনো উপন্যাস পড়ার সময় আমাদের মন ভবিষ্যদ্বাণী বা অনুমান করতে বাধ্য হয়। এতে কল্পনা শক্তি বাড়ে। তাই বই পড়ার অভ্যাস মস্তিষ্ককে স্মার্ট করে ও চিন্তার দক্ষতা বাড়ায়। যা আমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই ২০১২ সালে পাঠচক্রের শুরুটা হয়েছিল। যেখানে তরুণ শিক্ষার্থীরা ক্লাসের ফাঁকে একসঙ্গে বসে নানাবিধ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কার করবে। পাশাপাশি যুক্তিতর্ক ও জ্ঞানের আদান–প্রদান হবে সেখানে ।

পাঠচক্রের আরেক সদস্য আয়শা আক্তার। পড়ছেন সাংবাদিকতা বিভাগে। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর বই পড়তে ভালো লাগে। শীতের পড়ন্ত বিকেলে গল্প শোনার অনুভুতি প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশি এবং বিদেশি ভাষার নানা বই নিয়ে প্রতিটি পাঠচক্রই সদস্যদের গঠনমূলক আলোচনায় মুখর হয়। পাঠচক্রে আমার অংশগ্রহণ একজন শ্রোতা হিসেবে হলেও পুরোটা সময়ই উপভোগ করেছি। এত সুন্দর সাবলীল আয়োজনের জন্য সত্যি কৃতজ্ঞ। কাজের ফাঁকে জ্ঞানের চর্চার সুযোগ তো কম, এই পাঠচক্রের আসর সেই সুযোগ করে দেয়। নানা মতের, নানা ভাবনার মানুষের সম্মিলন হয় এখানে। পাঠচক্রের সদস্যরা জটিল বিষয়গুলো নিয়ে, নিজেদের কৌতূহলী বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান। এতে পাঠচক্রের তরুণ সদস্যরা আলোচক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পান।’
লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়