বাংলাদেশে প্রথমবার গারো মাহারি ফুটবল টুর্নামেন্ট: সীমান্তঘেঁষা বিড়ইডাকুনিতে জমকালো আয়োজন
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশের পাহাড়ি সীমান্তঘেঁষা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার বিড়ইডাকুনি গ্রামের স্কুল মাঠে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো গারো মাহারি ফুটবল টুর্নামেন্ট। গারো জাতিসত্তার ঐতিহ্য ও একতার প্রতীক এ আয়োজনে অংশ নেয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত গারো মাহারি বা পদবির প্রতিনিধিরা। ভিসা জটিলতায় ভারতের অনেক গারো মাহারি অংশ নিতে পারেননি।
টুর্নামেন্টের আহ্বায়ক তপু মানখিন বলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসা ও অংশগ্রহণে আমরা আপ্লুত। এই প্রথমবারের মতো দেশের সব গারো মাহারিকে একত্র করে এমন একটি চমৎকার মিলনমেলা আয়োজন করতে পেরেছি। মাহারি ফুটবল টুর্নামেন্ট আমাদের ঐক্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ঐতিহ্যের প্রতিফলন।’
অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার দর্শনার্থী উপস্থিত ছিলেন, যা গ্রামীণ পরিবেশে এমন আয়োজনকে করে তুলেছে অনন্য ও ঐতিহাসিক। দিনজুড়ে চলা এই আয়োজনে ছিল গারো সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ-সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রদর্শনী ও জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ।
অনেকে এই আয়োজনকে ‘গারো সংস্কৃতির বিশ্বকাপ’ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। এটি শুধু একটি টুর্নামেন্ট নয়, বরং গারো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের এক গর্বিত বহিঃপ্রকাশ।
গারো সংস্কৃতির জমকালো নাচ–গান দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নিজ নিজ মাহারির জার্সি পরে নিজেদের দলকে সাপোর্ট দিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন সবাই। কেউ দামা, রাং, আদুরীর (ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র) তালে মেতে ওঠেন খেলার মাঠের চারপাশে।
উৎসবমুখর পরিবেশে নিজ নিজ মাহারির গারোরা নিজেদের দলের খেলোয়ারদের জন্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন করেন। আপ্যায়নের কমতি ছিল না কোথাও।
লুসাই মারমা, গারো সংস্কৃতির এই মিলনমেলা বান্দরবান থেকে দেখতে এসে বলেন, ‘বিশ্বকাপেও আমি এমন আমেজ দেখিনি, যা আমার বন্ধু গারোদের মধ্যে দেখেছি। গারোদের আপ্যায়নে আমি মুগ্ধ।’
১ ও ২ আগস্ট সারা দিনব্যাপী ২৪টি দলের অংশগ্রহণে গ্রুপ পর্ব থেকে সেরা ৮ দলে উত্তীর্ণ হন মৃ, আতিওয়ারা, হাগিদক, চিরান, নকরেক, রাকসাম, রেমা ও মান্দা মাহারি।
অধিকাংশ ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়ে পয়েন্ট ভাগাভাগি হলেও নকরেক ও রেমা ছিল ব্যতিক্রম। নকরেক চ্রা রাকগা ৫-০ গোলে রংমা মাহারিকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেন। এ টুর্নামেন্টের ফেবারিট হিসেবে রয়েছে চিরান, মৃ, নকরেক। টুর্নামেন্ট আয়োজক কমিটি মানখিন মাহারি হওয়ায় সবচেয়ে ফেবারিট তকমা পাওয়া মানখিন মাহারির প্রতি সবার প্রত্যাশা ছিল ফাইনাল খেলার। কিন্তু তাঁরা হতাশ করেন।
খেলাধুলার পাশাপাশি ছিল দুই দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ও আইটি ক্যাম্প ছিল। চিকিৎসক পিন্টু নকরেক মাঠে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের গারোদের সব মাহারিকে মিলনমেলায় রূপান্তরিত করার জন্য আয়োজক তপু মানখিনকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা এমন মহান উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।’
আইটি ক্যাম্পের জন্য নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের সব অনলাইন–অফলাইন অফিস বন্ধ ছিল। সব টুর্নামেন্ট এর ম্যান অব দ্য ম্যাচের জন্য ৯০ শতাংশ পর্যন্ত স্কলারশিপের সুযোগ প্রদান করা হয়।
নকরেক আইটির সিইও সুবীর নকরেক বলেন, ‘এই মহতী উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের সকল মাহারির প্রিয় মানুষদের সাথে যে মিলনমেলা হচ্ছে, তা সত্যিই গারোদের জন্য ঐতিহাসিক বিষয়। আয়োজক কমিটিকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। এভাবে অব্যাহত থাকুক জীবনে জীবন মিলিয়ে এগিয়ে যাবার ও এগিয়ে নেবার মহতী উদ্যোগগুলো।’
বিড়ইডাকুনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রাদার জেমস সরকার বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আরও নান্দনিক খেলা পেতাম আমরা।’
খেলার উদ্বোধন করেন সমতল আদিবাসীদের বর্তমান নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় টিডব্লিউএ চেয়ারম্যান অরণ্য ই চিরান। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চিরান এ উদ্যোগের প্রশংসা করে পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে আয়োজনের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এই টুর্নামেন্ট উপলক্ষে আমেরিকা, ইতালি, ভারত, ফিলিপাইন, কানাডা থেকে গারো প্রবাসীরাও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। মিশিগান আমেরিকা থেকে মিশু রুরাম বলেন, চমৎকার আয়োজনের স্বার্থকতা কামনা করি। ইতালি থেকে চেংসি মৃ ভিডিও বার্তায় বলেন, সব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ফুটবল—অসাধারণ এক মিলনমেলা। সবার জন্য শুভকামনা।
পরের রাউন্ডের খেলা হবে ৮ আগস্ট।