বর্ষার আগমনী বার্তা, আজ বড় ভিজতে ইচ্ছে করছে!
বৈশাখের তাপপ্রবাহে জনজীবন যখন একাকার, জৈষ্ঠ্য মাসে আম-কাঁঠালের মুহুর্মুহু ঘ্রাণ, চারদিকে সেই ঘ্রাণে মাতোয়ারা প্রকৃতির সুবাতাস যেন ছড়িয়ে পড়েছে পরতে পরতে। এর মধ্যেই প্রকৃতির পরিবর্তনে এসে হাজির হয়েছে আষাঢ় মাস। দিয়েছে বর্ষার অঝোর বারিধারা, জানিয়েছে আগমনী বার্তা।
একপশলা বৃষ্টি! সঙ্গে ফুটবল, কাদায় ভিজে একাকার, আকাশে গর্জন, বাতাসে দুয়োধ্বনি, একস্লাইডে স্ট্রাইকারকে কুপোকাত। সব মিলে বর্ষায় ফুটবলের তুলনা যেন সে নিজেই। বৃষ্টিভেজা ম্যাচে থাকে না কোনো রেফারি, তাই দেখতে হয় না কোনো কার্ড। ফাউল চলছে, চলবেই। এরই মধ্যে কোনো এক অতিমানব স্ট্রাইকার বল নিয়ে স্লাইড থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, ট্যাকেল এড়িয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে যেই গোলের দেখা পায়। এবার আসে আসল স্বাদ। হুররে! বর্ষার পানিতে যেন জমে ক্ষীর! একসঙ্গে এবার সবাই পানির মধ্যেই মারো স্লাইড, কেউ দেয় পা আগে বাড়িয়ে, কেউ দেয় বুক। ব্যস! আহ সে কী দৃশ্য!
এই আনন্দ যে কেবল বর্ষারই দান। আষাঢ়ের পয়লা দিন গেল গতকাল। বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে নিয়ে ধরিত্রীপুরে নেমেছে বৃষ্টি। চারদিকে বইছে প্রকৃতির সুবাতাস, প্রকৃতি মেতেছে আজ কদমের ঘ্রাণে। এরই মধ্যে আজ মনে পড়ছে রবি ঠাকুরের সেই আষাঢ় মাসের কবিতা। ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।/বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,/আউশের খেত জলে ভরভর,/কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়াছে দেখ্ চাহি রে।/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’
কিন্তু বাদলা দিনে ঘরে কি মন বসে? আকাশ একটু কালো হলেই প্রস্তুতি চলতে থাকে কখন আকাশ চিরে বৃষ্টি নামবে, কখন ভিজতে বের হব। কবিগুরুর কথা যে মন আজ মানতে নারাজ। মন আজ মানছে না কোনো বাধা, শুনছে না কারও শাসন। বর্ষার আগমনকে কি ঘরে বসে স্বাগত জানানো যায়? এ যে বড্ড নারাজগি হয়ে যায় বর্ষার সঙ্গে। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে একগুচ্ছ কদম না দিতে পারলে সে যে ব্যর্থ প্রেমিক বলে প্রমাণিত হবে। ঠিক যেন গানের সুরে, ‘একগুচ্ছ কদম হাতে, ভিজতে চাই তোমার সাথে...’
কিশোর, তরুণ, যুবক, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার কাছেই যে এদেশের বুকে বর্ষার আবির্ভাব দাগ কেটে যায়। বয়স্ক ব্যক্তিরা তাঁদের নাতি-নাতনিদের গল্প শোনান, কীভাবে বর্ষায় তাঁরা সময় কাটাতেন। কী করে মাছ ধরা তাঁদের জন্য নেশার মতো ছিল, কী করে পুকুরে ডুবে গোসল করতেন, কী করে পানির মধ্যে লাই (চোর পুলিশ) খেলতেন, খালে, বনে-বাদারে, গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে চড়ে বেড়াতেন। সেসব সময় আজ তাঁদের কাছে অতীত। কিন্তু কিশোর-তরুণেরা যে চিরযৌবনা। যুগ যুগ ধরে বাঙালির সেই বর্ষার আনন্দ কমতে দেখা যায়নি কখনোই। দাদা-নানাদের সেসব গল্প বৃষ্টির দিনে শুনতেও যেন মন্দ লাগে না। কল্পনার রাজ্যে সেই সব ছবি আঁকার মধ্যে সুখ পাওয়ার কিছুটা হলেও চেষ্টা করছে শহরে বাস করা কিশোর-কিশোরীরা। কিন্তু গ্রামের হিসেব ভিন্ন। সেই চিরচেনা, চিরযৌবনা বর্ষাকে পুরোনো ধাঁচেই বরণ করে নিচ্ছে গাঁয়ের কিশোর-কিশোরীরা।
বর্ণনা করছিলাম বাদলদিনের ফুটবল ম্যাচের কথা। গ্রামে বড় হয়েছে, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বর্ষায় ভিজে একবার ফুটবল খেলেনি। সুযোগের অভাবে খেলতে না পারলেও একটিবারের জন্য খেলতে মন চায়নি, এমন কারও খোঁজ করা যেন নদীর জলে সুচ খোঁজার চেষ্টা। আজ সেই সব ফেলে আসা স্মৃতি যেন চোখের কোণে ভাসছে। তারা কেউ কেউ আজ পড়াশোনার জন্য পাড়ি দিয়েছে শহরের পথে, কেউ হয়তো পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। আজ এই বর্ষায় হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। মন চাইছে জৈষ্ঠ্য মাসের পাকা আম-কাঁঠালের ঘ্রাণে আরেকবার বুঁদ হয়ে যেতে। আজ মন চাইছে বৃষ্টিতে ভিজতে, গাছে চড়তে, কদম ছিঁড়তে, শাপলা তুলতে, আরেকবার নিরুদ্দেশে হারিয়ে যেতে।
আজ ভিজতে ইচ্ছা করছে। বড় ভিজতে ইচ্ছা করছে। খোলা আকাশের নিচে, মহুয়ার ডালে, সবুজ অরণ্যে, নদীর ধারে, গমখেতের মধ্যে সব বন্ধুকে নিয়ে আরেকবার ভিজি। মন বড় বাহানা ধরছে আজ। সত্যিই কি খুব দ্রুত বড় হয়ে গেলাম আমরা! কেনই বা সেই ছোটবেলায় বড় হতে চাইতাম, আজ কৈশোরের সেই আমিকে আজ প্রশ্ন করতে বড় ইচ্ছা করছে, কেনই–বা বড় হতে চাইতাম! আজ ঝরঝর বাদরমুখর দিনে বড় জানতে ইচ্ছে করছে। আজ এই পয়লা শ্রাবণ আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলছে। আমি আজ হারিয়ে যাবই। আয় কে আমার সঙ্গী হবি, চলে আয়। আমরা আজ নিরুদ্দেশ হব। আজ আমি বর্ষাকে পেয়েছি...
‘আজ ফিরে যাচ্ছি শৈশবে
মন ভোলানো কৈশোরে
ডেকো না আমায় অবসরে
আসব তবে উদ্ভবে।’
আজ আমি মায়ের বকুনি খাব। আদেশ অমান্য করব, ভিজতে যাব। আকাশের গর্জনও আজ পারবে না আটকাতে আমায়। আমি আজ ভিজবই। আমি মায়ের বকুনি খাবই আজ। খিচুড়ি রান্না করে মা অপেক্ষায় থাকবেন। আমি ফিরব না। আমি ভিজব, কদম ছিঁড়ব, বাড়িওয়ালার দৌড়ানি খাব, কোনো কিছুই আজ পাত্তাই দেব না। আজি বর্ষা এল ধরায়। বৃষ্টিতে ভিজে আমি জবুথবু হব। মায়ের বকুনি খাব। আজ বকুলতলায় যাব। পাখির সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে কথা কব, আমার আজ ছুটি, আমি আজ ভিজতে যাব।
আমার জন্য মা অপেক্ষা করবেন। খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে। রাখাল গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে, আমাকে দেখে সে ভাববে, পাগল হয়ে গেছি নাকি! না, আমি আজ ভিজব, সাধ করে ভিজব। কারও বাধা মানব না। পাহাড়ে চড়ব। পাহাড় পিচ্ছিল, পড়ে যাব, পা ছিলে যাবে, বাড়িতে গেলে মা বকুনি দেবে। যাব না বাড়িতে, আজ আমি ভিজব। আমি জানি, মা আমাকে খাওয়ানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। এ-ও জানি, আচ্ছা করে পিঠে কয়েকটা না লাগালে উনি শান্তি পাবেন না। আমি আজ থোরাই কেয়ার করি, আমি ভিজেছি।
আজ মাথা পেতে নেব পুরোটা শাস্তি আর বকুনি। আজ যে বর্ষা এল ধরায়। আমি বাড়ি ফিরব। খিচুড়ি খাওয়ার জন্য আমাকে যে ফিরতেই হবে। তা পিঠে দু–চারটা নাহয় পড়ল ঝাঁটার বাড়ি। আমি খুশি। আমি আজ ভিজেছি। বর্ষা যে এসেছে, আমি মাথা পেতে নিলাম সব। মায়ের হাতের খিচুড়ি খাওয়ার পালা এবার। বৃষ্টি এখনো থামছে না। মা এবার আমাকে খাওয়াবেন। চোখের পানি মুছবেন। আমি মাকে বলব, মা, আজ যে বর্ষার আগমন হয়েছে, তাকে আমি বরণ করে নিয়েছি, আমি আজ ভিজেছি, মা, আমি আজ ভিজেছি।
লেখক: তানভীর ইবনে মোবারক, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]