কুয়াশার চাদরে ঘেরা ইবির সবুজ ক্যাম্পাসের রূপ
দূর আকাশে ক্ষীণ চোখে দেখা যায় সবুজের মধ্যে কিঞ্চিৎ দালানকোঠার উপস্থিতি। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই ডান পাশে দেখা মিলল ‘মুক্ত বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয় খ্যাতিমান স্থপতি রশিদ আহমেদের নকশায়। ভাস্কর্যটির শীর্ষে দৃঢ় মুষ্টিতে আবদ্ধ একটি রাইফেল, যা দাঁড়িয়ে আছে সাতটি স্তম্ভের ওপর। স্তম্ভগুলো মুজিবনগরে গঠিত সাত সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার প্রতীকস্বরূপ। শীতের সকালে নান্দনিক এই ভাস্কর্যটি ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রেরণার উষ্ণতা ছড়ায়।
ভাস্কর্যটির রাস্তার অপর পাশে দৃষ্টিনন্দন দুটি স্থাপনা গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এই স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনার অতীতের বীরত্বগাথা ও ভবিষ্যৎ অধিকার আদায়ের সোচ্চার থাকার প্রেরণা জোগায়। কুয়াশার চাদরে মোড়া এগুলো ইটের স্থাপনা হলেও মনে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে এগুলো আজও জাতিকে সজাগ রাখে।
আরও কাছে যেতেই চোখে পড়ে বিভিন্ন স্লোগানে অঙ্কিত দেয়াল, যা নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। যার আশপাশে দিয়ে এঁকেবেঁকে নদীর মতো বিস্তৃত পাকা রাস্তা। আরও কাছে যেতেই কুয়াশায় ঝাপসা চোখে দেখা যায় ঝাল চত্বরে বন্ধ দোকানপাট, ডায়না চত্বর, পাই চত্বর, বটতলা ও প্যারাডাইস রোড। সবই এখন জনমানবশূন্য। বলছি চিত্রকরের রঙের তুলিতে আঁকা ছবির মতো ক্যাম্পাস কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। শীতের সকালে গভীর ঘুমে থাকা শিক্ষার্থী, শিক্ষকেরা ও কর্মকর্তা সবাই নিজেদের শীতের প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে উষ্ণতার সন্ধানে। কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকা ক্যাম্পাসে প্রতিটি বস্তুই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার টুপটাপ করে শিশিরভেজা ভবনের দেয়ালের পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে যেন মানুষের মতোই শীতের হাড়কাঁপানো ঠান্ডার কাছে কান্নাজুড়ে মিনতি করছে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
এভাবেই প্রতিটি বস্তু পরখ করে কাঁচা-পাকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলল মীর মুগ্ধ সরোবর, যা মফিজ লেক নামে পরিচিত। ক্যাম্পাসের শেষ প্রান্তে এখন অবস্থিত এই লেক যার পানি এখনো শুকিয়ে যায়নি। লেকের প্রাণ এখনো দীপ্ত রয়েছে। লেকের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে দূর দিগন্তের সবুজ প্রান্তর দেখা যায়। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা সবুজ জগতের সঙ্গে নিজেদের প্রেমের বন্ধন ঘটায়। শীতের এই মৌসুমে প্রান্তরটি কুয়াশার চাদরে আবৃত থাকে। টাওয়ারের ওপর থেকে লেকটাকে একটি ভাঁজ করা আয়নার মতো দেখায় যেখানে প্রকৃতি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
এই শীতের সকালে আবাসিক হলগুলো থাকে নিস্তব্ধতায়। কেউ ঘুমে, কেউ হাঁটায়, কেউবা পড়ায় মগ্ন থাকে। পুবাকাশে সূর্যের উঁকি ধীরে ধীরে তার স্বভাবগত তেজ ছড়িয়ে পরিবেশকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে সকালে সূর্যের মিষ্টি রোদে পুরো ক্যাম্পাস দৈনন্দিন কার্যাবলিতে ফিরে আসে। মিষ্টি রোদের তাপ শিক্ষার্থীরা গায়ে মাখিয়ে ক্লাসে যায়। এভাবে দিনের প্রথম প্রহরে ক্যাম্পাসে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সময়ে সব ক্লাস-পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ চলে। আর এই সময় মূলত ক্যাম্পাসের ঝাল চত্বরে ক্লাসের ফাঁকে মিষ্টি রোদে কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খোশগল্প মেতে ওঠে, কেউ ক্লাস-পরীক্ষা শেষে কিছুটা বিশ্রামের খোঁজে, কেউবা ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টায় থাকে।
ঝাল চত্বরের ঠিক দক্ষিণ পাশে অন্যতম সাংস্কৃতিক মিলনকেন্দ্র বটতলা। যেখানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজ করে থাকে। যেমন হৈমন্তী, কুহেলিকা, বৈশাখীয়ানা, মেহেদি উৎসব ইত্যাদি। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি আদায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদও এখানে করে থাকে। আর বটবৃক্ষটি পরম মমতায় নিজের ডালপালা বিস্তৃত রেখে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চর্চা, সুপ্ত প্রতিভা ও নেতৃত্ব বিকাশের সবুজ প্রাঙ্গণ তৈরি করে। এভাবেই বৃক্ষটি নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি কর্মের।
খোলা আকাশের সূর্য তার মিষ্টি উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে যখন পশ্চিম আকাশের অভিমুখে, তখন ক্যাম্পাস উত্তাপহীন হালকা ঠান্ডা পরিবেশে থাকে। এ সময় জিয়া মোড়সংলগ্ন এলাকায় শুরু হয় শীতকে স্বাগত জানিয়ে বাহারি পিঠা বানানো। পিঠাপ্রেমীরা পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণে রাস্তার পাশে অস্থায়ী দোকানগুলোয় ভিড় জমায়। মাটির চুলার ভেতর থেকে দাউ দাউ করা আগুনের দৃশ্য, এর তাপে পিঠা থেকে ওড়া সাদা ধোঁয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া, সেই সঙ্গে মিষ্টি এক গন্ধ নাকে লেগে ক্ষুধার তাড়না বাড়িয়ে তুলছে, আবার কেউ চুলার পাশে বসে নিজেকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা। এমন এক অনুভূতিতে যখন পিঠার প্রথম কামড় দেওয়া হয়, তখন জিবের প্রতিটি গ্রন্থি থেকে স্বাদ উদ্গ্রীব রস বের হয়ে আসে, যা স্বাদকে বহুগুণ বাড়ায়।
এভাবে সূর্য তার চিরায়ত স্বভাবের মতো দিনকে বিদায় জানিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে। সেই সঙ্গে শীত স্বভাবগত আচরণে আবারও সূর্যের অনুপস্থিতিতে জেঁকে বসে। আবারও শীত থেকে বাঁচতে গরমপোশাক পরে উষ্ণ থাকার চেষ্টা। এভাবে রাত যত গভীর হয়, কুয়াশা তত জেঁকে বসে। আর রাতে কুয়াশায় আচ্ছন্ন ক্যাম্পাস যেন বিশ্রামে থাকা কোনো গ্রন্থনগরী, যা দিনের আলোয় জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে প্রাণ ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায়।
* লেখক: আবু বকর, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া