আমার প্রিয় শহর চট্টগ্রামের অলিগলি
চট্টগ্রাম শহর একটি প্রাচীনতম শহর। এখানে অনেক স্থাপনা আছে যা খুবই পুরোনো কিন্তু ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। চট্টগ্রাম শহর গড়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে। এখানে পাহাড়, সমতল ও বিশাল জলরাশি ঘেরা পর্যটন নগরীর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের ভিড়ে পর্যটকদের হৃদয় হরণ করে নেয়। পৃথিবীর অনেক দেশ আমরা এখন গুগলে, ইউটিউবের বদৌলতে দেখতে পাই। তখন যদি আপনার–আমার প্রিয় চট্টগ্রাম শহর সার্চ দিয়ে দেখেন, পাখির চোখে কত সুন্দর গোছানো এ প্রাণের শহর তখন অবলোকন করা যায়। চট্টগ্রাম বন্দর, সিআরবি, জিলাপীর পাহাড়, ডিসি হিল, এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের আশপাশ, বিভিন্ন ঘরানার খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ দেখে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। ফুসকা থেকে শুরু করে হায়দরাবাদী বিরিয়ানি—কী নেই এখানে!
চট্টগ্রাম শহরে এক চিলতে সুখের হাতছানি সবুজের সমারোহ সি আর বি, ডি সি হিল এবং টাইগার পাস ও লালখান বাজারের কাছে বাটালী বা জিলাপী পাহাড়। ভাবুকদের একমনে ভাবার অবকাশ করে দেয় যেন এসব সবুজের সুনিপুণ সৌন্দর্যের উঁচু–নিচু, আঁকাবাঁকা পিচঢালা রাস্তা। যেকোনো বয়সের প্রকৃতিপ্রেমীরা ঘুরে আসতে পারেন এসব জায়গায়। আর সমুদ্রের উঁচু মনকাড়া ঊর্মিমালার গর্জন শুনতে চান, তাহলে দৃষ্টিনন্দন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ঘুরে আসতে পারেন। মন জুড়িয়ে যাবে শতভাগ নিশ্চিত।
চট্টগ্রাম নেভাল, প্রজাপতি পার্ক, ফয়’স লেক, সি ওয়ার্ল্ড, ছোট্ট নৈর্সগিক কৃত্রিম হ্রদ যে কারও হৃদয় কেড়ে নেবে, যা এতটাই সুন্দর ও মনোলোভা।
পুরোনো শহরের স্থাপনার মধ্যে রয়েছে চন্দনপুরা মসজিদ, কোর্ট বিল্ডিং, আন্দরকিল্লাসহ বহু জায়গায়।
বারো আউলিয়ার পূণ্য ভূমি আমাদের চট্টগ্রাম। শাহ আমানত (রহ.), মিসকিন শাহ (রহ.), বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.), পরী বিবি (রহ.)–সহ অনেক আউলিয়া–বুজুর্গ এই শহরে শায়িত আছেন। অন্যান্য ধর্মের তীর্থস্থান ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে এসব স্থাপনা সুসজ্জিত আছে। চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর একতা, একাত্মবোধ ও সম্প্রীতি চট্টগ্রামকে অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এখানে সবাই শান্তিতে বসবাস করে একসঙ্গে, একই গলিতে আর একই দোকানে চায়ের আড্ডায় সামিল হয়। নিয়মিত সাহিত্য আড্ডাসহ নানা সাহিত্যচর্চাবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করে চট্টগ্রাম একাডেমি, প্রেসক্লাব, বাতিঘর, চন্দ্রবিন্দু, মাসিক আন্দরকিল্লাসহ অনেকে। চেরাগী পাহাড় চট্টগ্রামের পবিত্রতম জায়গা। জামালখান রোডে আছে বইয়ের পসরা সাজানো চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নিচতলায় অবস্থিত বাতিঘর। আরও আছে অমর বই ঘর। বই পড়া ও দেখার এগুলো একটুকরা প্রশান্তির জায়গা পাঠকদের। ছুটির দিনে এসব জায়গায় পাঠকের ভিড় দেখলে ভুলে যাবেন আজকাল মোবাইলে কেবল মানুষ থাকে না বরং বইয়ের সঙ্গেও আটার মতো লেগে থাকে। তবে এ রকম আরও বইঘর থাকা উচিত। জ্ঞানের দ্বার সব সময় খুলে রাখা উচিত।
ঐতিহ্যবাহী কলেজিয়েট হাইস্কুল, ডা. খাস্তগীর উচ্চবিদ্যালয়, বাওয়া উচ্চবিদ্যালয়, মুসলিম হাই স্কুলসহ অন্যান্য, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, হাজী মুহম্মদ মহসীন সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি কর্মাস কলেজসহ অসংখ্য ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ শহরে বিদ্যমান। জেলা শিল্পকলা একাডেমি, থিয়েটার হল, শিশু একাডেমিসহ অনেক সংস্কৃতিচর্চার স্থাপনা আছে। এখানকার মাছের আড়ত, মসলার আড়ত, চাক্তাই শুটকির আড়ত দেখার মতো। কর্ণফুলী ব্রিজ, সদরঘাট, মেরিন একাডেমি অন্যরকম সুন্দর স্থাপনা এ শহরকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। এক কথায় ছোট্ট পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না চট্টগ্রাম শহরের অলিগলিতে আরও কত সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহ্য ও স্থাপনা লুকিয়ে আছে।
চট্টগ্রাম শহরের রাতের সৌন্দর্য আরও বিভোর করার মতো। সোডিয়াম, নিয়ন লাইটের মাঝখানে প্রতি রোডে রিকশার হুট খুলে দিয়ে ঘুরলে একটা অদ্ভুত আনন্দানুভূতি তৈরি হয়। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারসহ অন্যান্য ফ্লাইওভার এতই সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজানো, গাড়ি দিয়ে গেলে মনে হয় ইউরোপীয় কোনো উন্নত দেশে বাস করছি।
আমাদের চট্টগ্রাম আজ অনেকটাই উন্নয়নের ছোঁয়ায় এগিয়েছে, যা স্বচক্ষে আমরা দেখছি ও সুযোগ সুবিধাভোগ করছি। এ কোনোভাবে অস্বীকার করার জো নেই। সরকারি নির্দেশনা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নগর পিতা ও কাউন্সিলররা যথেষ্ট খাটছেন চট্টগ্রাম শহরের শ্রী বৃদ্ধির জন্য।
চট্টগ্রাম শহরে সবচয়ে বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা এবং অপরিকল্পিত দালানকোঠা ও ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণে এ শহরকে শ্রীহীন করে দিচ্ছে। বর্তমানে অনেক নির্মাণকাজ চলমান কিন্তু তা ধীরগতিতে চলছে।
তাই এখনই তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। বঙ্গোপসাগর উপকূলে গড়ে ওঠা এই শহরটি প্রাচীনতম একটি বাণিজ্যিক শহর। এ দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি থাকা এ শহরে নোঙর করে দেশ–বিদেশের আমদানি–রপ্তানির নৌবহর। তাই পরিকল্পিত নগরীর দরকার বটে। সমুদ্রের পাড় ভেঙে ভেসে যেতে দেওয়া যাবে না আমাদের প্রাণের শহর চট্টগ্রামকে। আসুন সবাই যে যার জায়গা থেকে নিজভূমিকে ভালোবাসি। আসুন ভালোবাসা ছড়াই।
লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক; চট্টগ্রাম