ঢাকা বাণিজ্য মেলায় এক বেলা

শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি)। ছুটির দিন। ভোর হতেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। বাণিজ্য মেলায় প্রথম যাচ্ছি, তাই আনন্দটা একটু বেশিই ছিল। সকালের নাশতা সেরে চলে গেলাম পরিবহন চত্বরে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল লালরঙা ডাবল ড্রেকার বাসটি। তবে কোনো আসন খালি ছিল না। একটু অপেক্ষা করতেই আরও একটি বাস এসে উপস্থিত। বাসে উঠতেই চলা শুরু করল। যেহেতু আমি রাজধানীর পূর্বাচল যাব, তাই বাস থেকে টেকনিক্যাল মোড়ে নেমে গেলাম। এরপর নতুন আরেকটি বাসে চড়ে কুড়িল বিশ্বরোড পৌঁছালাম। এদিকে মেলা উপলক্ষে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা ছিল। ৩৫ টাকার টিকিটে খুব সহজেই পৌঁছে গেলাম মেলা প্রাঙ্গণে।

মেলার প্রধান প্রবেশদ্বারে দীর্ঘ লাইন দেখতে পেলাম। টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। চারদিক বেশ সাজানো-গোছানো। দৃষ্টিনন্দন আলোকোজ্জ্বল পানির ফোয়ারার চারদিকে ছিল মানুষের সরব উপস্থিতি। কেউবা ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউবা আবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই মুহূর্তটাই উপভোগ করতে ব্যস্ত ছিলেন।

এবারের বাণিজ্য মেলায় প্রথম ছুটির দিন। তাই মেলায় ছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। বেলা বাড়তেই মেলা প্রাঙ্গণ ক্রেতা-দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। শুধু ঢাকা শহর নয়, আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও প্রচুর মানুষ এসেছিলেন মেলা প্রাঙ্গণে। মেলায় কেউ এসেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে, কেউবা এসেছেন বন্ধুবান্ধবের নিয়ে। অনেকে আবার একাই এসেছেন বাণিজ্য মেলা পরখ করে নিতে। মেলার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলো ছিল তাই লোকে লোকারণ্য।

মেলায় আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগেরই মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে ছবি তুলে সময় কাটাতে দেখা গেছে। আবার অনেকে পছন্দের পণ্যটি খুঁজছেন এবং কেনাকাটা করেছেন।

এদিন বাণিজ্য মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়নে ক্রেতাদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। গৃহস্থালির সামগ্রী, বিস্কুট, আচার, আইসক্রিম, মেলামাইন, পোশাক, নারীদের প্রসাধনী, অলংকার, বাচ্চাদের খেলনা, সিরামিক, ফার্নিচার আইটেম, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র কিনতে ক্রেতাদের আগ্রহ দেখা গেছে। বিদেশি স্টলগুলোর মধ্যে তুর্কি স্টল ছিল বেশ দৃষ্টিনন্দন ও নজরকাড়া। তুর্কি স্টলে নারীদের পছন্দের জিনিসপত্র রয়েছে। এ ছাড়া ঘর সাজানোর চমৎকার লাইটিংসহ আসবাব রয়েছে। চীনা ও ইরানি স্টলেও মানুষের ঢল ছিল।

দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন ফার্নিচার প্যাভিলিয়নে দর্শনার্থীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। আগ্রহ নিয়ে অনেকেই পছন্দের ফার্নিচার দেখছিলেন। অনেকে কোনো কোনো ফার্নিচার প্রতিষ্ঠানে কত ছাড় দিচ্ছে, তার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। রোকেয়া জান্নাত নামের এক ক্রেতা জানান, ঘর সাজাতে ফার্নিচার জরুরি। মেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিত্যনতুন নকশার ফার্নিচার একসঙ্গে পাওয়া যায়। এর ফলে দেখা ও যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। সেই সঙ্গে থাকে বিশেষ ছাড়। যে কারণে তিনি মেলা ঘুরে পছন্দ করছেন আসবাবপত্র।

মেলায় উৎপাদনকারীরা নিত্যনতুন ও অধিকতর মানসম্পন্ন পণ্য নিয়ে ভোক্তার সামনে উপস্থিত হন। এতে দেশি-বিদেশি ভোক্তারা বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। ক্রেতা-বিক্রেতা ও উৎপাদনকারীদের মধ্যে একধরনের প্রত্যক্ষ সংযোগ হয়। বাণিজ্য মেলা উৎপাদনকারীদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে দেয়, যা পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি, পণ্যে বৈচিত্র্য আনা, মূল্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং উৎপাদনকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। সেই সঙ্গে উৎপাদনকারীরা নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত হয় এবং এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাণিজ্য মেলা অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মেলায় অংশ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার সুসংহতসহ নতুন নতুন পণ্য ও সেবার পরিচিতির মাধ্যমে ব্যবসার সম্প্রসারণ করে থাকে। এ ছাড়া মেলার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায়। এসব কারণে এ মেলা আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মেলা আয়োজনের জন্য অবকাঠামো ও প্যাভিলিয়ন নির্মাণ, সজ্জিতকরণ, মালামাল বহন, বেচাকেনাসহ নানা কাজে প্রচুর জনবলের প্রয়োজন হয়। মেলার মাধ্যমে দক্ষ-অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ জনবলের মৌসুমি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

এবার মেলায় গৃহস্থালি পণ্যের দোকানগুলোয় নন-স্টিক পণ্যে বিভিন্ন ধরনের ছাড়ের পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যেও রয়েছে ছাড়। এসব স্টল থেকে একাধিক পণ্য কিনলে ক্রেতারা পাচ্ছেন কোনো না কোনো ছাড়। কোনো কোনো বিক্রেতা একটি পণ্যের সঙ্গে একটি পণ্য ফ্রি দিচ্ছেন। অনেকে তাঁদের পণ্য প্যাকেজ (১টির সঙ্গে ৫-১০ গিফট) আকারে বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ পণ্যের মূল্যের ওপর সরাসরি ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছেন।

এদিকে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, মেলা চলাকালে পণ্য কিনলে ক্রেতারা ছাড় পাবেন অনেকটা। মেলা উপলক্ষে নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য আনা হয়েছে।

বড় প্রতিষ্ঠানগুলো হলো একেকটি ব্র্যান্ড। ভোক্তার বা ক্রেতার কাছে মানসম্পন্ন পণ্যের প্রতিশ্রুতি দেয় ব্র্যান্ড। ব্র্যান্ডিংয়ের খ্যাতি ও কদর থেকেই বাজারে প্রভাব ও মূল্যমান এবং ব্র্যান্ডের পণ্য ক্রয়ের মানসিকতা তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। ব্র্যান্ড বলতে এমন কোনো নাম, শব্দ, ডিজাইন, প্রতীক বা অন্য কোনো ফিচার বোঝায়, যা কোনো একজন বিক্রেতার পণ্য বা সেবাকে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে। ভালো কোয়ালিটি, দারুণ ফিনিশিং, স্থায়িত্ব ব্র্যান্ডের এই বৈশিষ্ট্যগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই।

ক্রেতা বা ভোক্তারা একটি ব্র্যান্ডের ওপর বিশ্বাস রাখলে অতিরিক্ত খরচ হলেও সেখানেই তাঁরা যেতে প্রস্তুত থাকেন। ভোক্তাদের অনেকেই এটিকে অতিরিক্ত খরচ হিসেবে মনে করেন না। এ জন্য বাণিজ্য মেলায় বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দোকানে বেশি ভিড় দর্শনার্থীদের।
ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্যাভিলিয়ন ও স্টল দৃষ্টিনন্দন করে সাজিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্যাভিলিয়ন ও স্টলে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে নিজেদের পণ্য। দর্শনার্থীরা এসে সেসব পণ্য ঘুরে ঘুরে দেখছেন। সঙ্গে জানতে চাচ্ছেন মেলা উপলক্ষে কী কী অফার রয়েছে। কেউ কেউ পছন্দের পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

জনবহুল ঢাকায় নগরবাসীর জন্য বাণিজ্য মেলা বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় কেনাকাটার সঙ্গে বিনোদনেরও সুযোগ রয়েছে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। এবারও শিশুদের বিনোদনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে মিনি শিশুপার্ক। হইহুল্লোড় আর উচ্ছ্বাসে একটু বেশিই প্রাণবন্ত বাণিজ্য মেলার ছোট পরিসরের এ শিশুপার্ক। ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করে হাঁপিয়ে ওঠা যে কেউ মনে প্রশান্তি আনতে ঢুঁ মারতে পারেন সেখানে, মারছেনও।

মেলা মানেই প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির একক সমাহার। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গৃহস্থালি পণ্যের রয়েছে ব্যাপক। এসব চাহিদা পূরণ করতে মানুষকে যেতে হতো ভিন্ন ভিন্ন মার্কেটে, যা ছিল খুবই ক্লান্তিকর এবং অস্বস্তিকরও বটে। তবে বাণিজ্য মেলা নগরবাসীর সেই ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে। হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সবকিছু। মেলায় সব ধরনের গৃহস্থালি পণ্য এক জায়গায় পাওয়া যায়। তাই ক্রেতারা একটি জায়গা থেকেই পছন্দসই জিনিস কিনতে পারেন।

পঞ্চাশোর্ধ্ব এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তাঁর নাম আক্তার হোসেন। তিনি রাজধানীর আজিমপুর থেকে এসেছেন। অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আগারগাঁওয়ে যখন মেলার আয়োজন করা হতো, তখন রাজধানীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হতো। এখানে সেটি নেই। অনেক বড় জায়গায় আয়োজন। পরিবেশটা বেশ সুন্দর। আজকে ঘুরতে এলাম; পাশাপাশি যদি কোনো কিছু পছন্দ হয়, সেটিও কিনব।’

বাণিজ্য মেলা তো শুধু পণ্য বেচাকেনার জায়গা নয়, লাখো মানুষের মিলনমেলাও বটে। যেখানে প্রাণ, সেখানে তো আনন্দ থাকবেই। বাণিজ্য মেলায় প্রতিদিন হাজারো মানুষের দেখা মেলে। মানুষের সঙ্গে দেখা, মানুষের সঙ্গে কথা। এর চেয়ে আনন্দ আর কোথায় মেলে! আর এই আনন্দের মধ্য দিয়েই সবার জীবনের অভিজ্ঞতা বাড়ছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]