শতবর্ষে ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র উৎসব

সেদিন ছিল এক ব্যতিক্রমী দিন। সবুজ নিবিড়ে ঘেরা ৩২ একরের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) ইংরেজি বিভাগের করিডরে পা রাখতেই মনে হলো যেন কোনো সাহিত্যিক জাদুর ভুবনে প্রবেশ করেছি। চারপাশ সজ্জিত বর্ণিল আলোয়, দেয়ালে ঝুলছে এডওয়ার্ড মরগ্যান ফস্টারের অমর কীর্তি ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র বিভিন্ন দৃশ্যচিত্র। আরেক পাশে বইয়ের স্তূপে সাজানো উপন্যাসটির নানা সংস্করণ। সেই করিডরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে যেন ১৯২৪ সালে ফিরে গেছি—ব্রিটিশ ভারতের দিনগুলো যেন সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

এই মহাযজ্ঞের নেপথ্যের গল্পটা শুরু হয়েছিল ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফরোজা সিদ্দিকার এক ভাবনায়। ‘কেন আমরা ফস্টারের এই মাস্টারপিসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করব না?’ তাঁর সেই প্রস্তাব যেন মুহূর্তেই সবার মনে সাড়া ফেলে। সবাই যেন মুগ্ধ হয়ে সেই ভাবনা গ্রহণ করল। এরপর শুরু হলো প্রস্তুতির পালা। বিভাগের ৩২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিলেন এই আয়োজনে। রাত-দিন পরিশ্রম, পরিকল্পনা আর সৃজনশীলতায় তাঁরা এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান উপহার দিতে প্রস্তুত।

সেদিন দুপুরে লাল ফিতা কেটে উৎসবের সূচনা করেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক এবং প্রখ্যাত অধ্যাপক মনসুর মুসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অফিসার ও আবৃত্তি শিল্পী এনামুল হক। এরপর অতিথিদের বক্তব্য যেন ফস্টারের উপন্যাসের গভীরতাকে আরও জীবন্ত করে তুলল। তাঁদের কথায় যেন দর্শকদের হৃদয়ে নতুন করে সাহিত্যপ্রেম জেগে উঠল।

এরপর উপস্থিত সবাই একটি বিশেষ মুহূর্তের সাক্ষী হলো—এক নীলাভ সজ্জিত কেক কাটা। কেকটির ওপর বড় করে লেখা ছিল, ‘A Century of A Passage to India’। শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত হাত ধরে কাটা হলো এই কেক। মুহূর্তটি ছিল আনন্দে ভরা, যেন শতবর্ষের গৌরব ভাগাভাগি করার এক অনন্য উদ্‌যাপন।

কিন্তু মূল আকর্ষণ ছিল এরপর। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপন্যাসটির বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে মঞ্চনাটক পরিবেশন করলেন। পুরো প্রেক্ষাগৃহ যেন মুহূর্তেই রূপ নিল ব্রিটিশ ভারতের একটুকরা মঞ্চে। একজন অভিনয় করলেন ডক্টর আজিজ, যার চরিত্রে ফুটে উঠল এক হৃদয়বৃত্তি ও ভুল–বোঝাবুঝির গল্প। আরেকজন হয়ে উঠলেন অ্যাডেলা কোয়েস্টেড, যার দোদুল্যমান মন এবং সংস্কৃতির সংঘর্ষ দর্শকদের আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মঞ্চে ম্যাজিস্ট্রেট ফিল্ডিংয়ের চরিত্রও ছিল অসাধারণ। শিক্ষার্থীদের অভিনয়ের গভীরতা আর উপস্থাপনার মুনশিয়ানায় যেন উপন্যাসটি নতুন করে প্রাণ পেল। নাটক শেষে করতালির গর্জনে পুরো মহল কেঁপে উঠল।

নাটকের মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই মঞ্চে উঠলেন নৃত্যশিল্পী আফিয়াত মিথী। তাঁর নৃত্য যেন একেবারে ভিন্ন মাত্রার এক অভিজ্ঞতা। তাঁর পরিবেশনায় যেন কাব্যের ছন্দ আর ঐতিহ্যের রূপ এক হয়ে গেল। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ভঙ্গিমা দর্শকদের এক নতুন মোহের জগতে নিয়ে গেল।

অনুষ্ঠান শেষে দর্শকদের মন যেন ছিল ভারী। এক তরুণ শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই আয়োজন শুধু একটি উৎসব ছিল না; এটি ছিল ইতিহাস, সাহিত্য আর সংস্কৃতির এক অনন্য মেলবন্ধন। আমরা শুধু একটি উপন্যাস উদ্‌যাপন করিনি, উদ্‌যাপন করেছি আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে।’

এভাবেই শেষ হলো সেই মহোৎসব। কিন্তু অনুষ্ঠানের পরও যেন সেই আবেগ, সেই মোহময়তা কাটতে চাইছিল না। সেদিন যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের জন্য এটি শুধু একটি দিন নয়, বরং এক চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে থাকবে। ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’-র শতবর্ষ যেন আরও একবার প্রমাণ করল, সাহিত্যই পারে সংস্কৃতি, ইতিহাস আর আবেগকে একসঙ্গে বেঁধে রাখতে।

লেখা: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।