ট্রুডো–সোফির বিবাহবিচ্ছেদ বনাম গ্লাস্তনস্ত-প্রেস্ত্রোইকা
‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ইতিবাচক, তবে বাস্তবে এটি দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তুলতে পারে। শব্দটি কখনো বিচ্ছেদ, সম্পর্কচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা, মুক্ত ইত্যাদি অর্থে প্রয়োগ হতে দেখা যায় স্থান, কাল, পাত্রভেদে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতা শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যেমন ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হয় এবং একই সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয় আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়।
এখানে দেখা গেছে ভূখণ্ডগত, সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ইত্যাদি দিক থেকে দেশগুলো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়েছে। আবার ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভের গ্লাস্তনস্ত-প্রেস্ত্রোইকা নীতিতে এক স্বাক্ষরের মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৫ রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়াসহ বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র ছিল, বর্তমানেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাশিয়া সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানে আছে। দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান কিন্তু পার্থক্য বিস্তর।
সম্প্রতি সামরিক শক্তির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১০০ ভাগ সামরিক শক্তির ৭৪ ভাগ শুধু যুক্তরাষ্ট্র দখলে নিয়ে প্রথম স্থান আর ৫ ভাগ নিয়ে রাশিয়া দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে স্বাধীনতার বিপরীত দিকে রাষ্ট্রগুলোকে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন জোট গঠন করে জোটবদ্ধ হয়ে চলতে দেখা যায়। যেমন জাতিসংঘ, ন্যাটো, ওয়ারশ প্যাক্ট, আরব লিগ, ওআইসি, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ন্যাম ইত্যাদি জোটে আবদ্ধ হয় রাষ্ট্রগুলো নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য এবং বিপরীত শক্তির হামলা থেকে নিরাপত্তার জন্য। জোট শক্তিশালী কিন্তু স্বাধীনতার বিপরীত কারণ জোটে অনেক শক্তির সমন্বয় হয় আবার স্বাধীন মতামত উপেক্ষিত হয় এবং জোটের আইনকানুন মেনে চলতে হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা সংযুক্ত আরব আমিরাত বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সমন্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে সিকিম ১৯৭৫ সালের ১ মে স্বাধীনতা ত্যাগ করে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতে ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে অঙ্গীভূত হয়ে পরাধীনতাকে বেছে নেয়।
পারিবারিক বা বৈবাহিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নামে তালাক, বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্স শব্দ হিসেবে প্রয়োগ হয়। তালাক বিষয়টিকে যে নামেই আমরা ডাকি না কেন, এটি ইসলাম তথা সবার কাছে অপছন্দনীয় কাজ, তবে বৈধ। তবু সমাজে কেন স্বাধীনতার নামে এত বিবাহবিচ্ছেদ? একটু পর্যবেক্ষণ করলেই বিপরীত পক্ষের প্রতি আস্থাহীনতা, মতের অমিল, শ্রদ্ধার অভাব, ত্যাগ, সহানুভূতির অনুপস্থিতি, পারিবারিক, বৈবাহিক বা সামাজিক চুক্তিকে তোয়াক্কা না করে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করার চিন্তাচেতনা, অসমবিবাহ বহিঃশক্তির অনুপ্রবেশ বা উসকানি থেকেই বেশির ভাগ তালাক, স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতা হয়ে থাকে।
এগুলো শুধু সাধারণ মানুষ বা সাধারণ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে হলে খুব একটা অবাক না হলেও আমরা অবাক হই, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন যেটি আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বে সর্ববৃহৎ বা প্রায় অর্ধপৃথিবী নিয়ে যার অবস্থান, সেই রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতার নামে ১৫টি রাষ্ট্র বেরিয়ে যায়। অবাক হই যখন বিশ্বে প্রযুক্তির সেরা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের স্বত্বাধিকারী এবং পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের শীর্ষে থাকা বিল গেটস এবং তার সহধর্মিণী মেলিন্ডা গেটসের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার এক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
আরও অবাক হই যখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র কানাডার প্রধানমন্ত্রী সফল রাষ্ট্রনায়ক বা বিশ্বের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ জাস্টিন ট্রুডো এবং তাঁর স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ার মধ্যে মিখাইল গর্ভাচেভের গ্লাস্তনস্ত-প্রেস্ত্রোইকার এক স্বাক্ষরের মতো পারস্পরিক সমঝোতার এক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এই দম্পতির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় প্রটোকল, সন্তানসন্তুতি, যশ-খ্যাতি সবই ছিল, তবু কেন বিচ্ছেদ, এই প্রশ্নটি অবশ্যম্ভবী হয়ে উঠে আর সেটিরও উত্তর স্বাধীনতা অর্থাৎ স্বাধীন মতামতের প্রতিফলনের জন্য এই বিভাজন।
রাষ্ট্র যখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যেকোনো কারণে পৃথক হয়ে যায়, তখন রাষ্ট্রটি আপাতদৃষ্টে দুর্বল হলে রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রের জনগণের সুবিধা বা অসুবিধা দুটিই হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে স্বাধীনতার নামে তালাক হলে হয়তো আপাতদৃষ্টে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক দৃষ্টিতে সুবিধাজনক স্থানে দেখতে পারে আবার একজন বা উভয়ে অসুবিধাজনক স্থানেও থাকতে পারে। তবে ওই দম্পতির যদি সন্তানসন্তুতি থাকে, এটি নিশ্চিত ওই সন্তানসন্তুতি সব দিক দিয়েই অসুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করে। যেটি ট্রুডো-সোফি, বিল-মেলিন্ডা বা সব দম্পতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এই সমস্যার সমাধান হতে পারে অভিভাবকদের নিজেদের সন্তানসন্তুতি বিয়ে দেওয়ার সময় সমতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, বংশপরিচয় ইত্যাদির প্রতি লক্ষ রাখা।
সব দম্পতির উচিত ইগো পরিহার করে স্বামী বা স্ত্রী নিজেকে আলাদা স্বত্তা মনে না করে দুজনকে নিয়ে একটি পরিবার বা সংসার মনে করে কীভাবে সেই পরিবার বা সংসারের উন্নয়ন করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা এবং উভয়ের মধ্যে কোনো অবিশ্বাস, সংকট বা সমস্যার সৃষ্টি হলে সেটি নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা। বিশেষ করে যেসব দম্পতির সন্তানসন্তুতি রয়েছে, তাদের সন্তানসন্তুতির মঙ্গলের জন্য এবং নিশ্চিত অকল্যাণ থেকে রক্ষা করার জন্য পরিবার বা সংসারের প্রতি সর্বোচ্চ ত্যাগ করলে সামাজিক বা ধর্মীয় অপছন্দনীয় কাজ হতে যেমন নিজেদের রক্ষা করা করা যাবে, তেমনি সন্তানসন্তুতি নিশ্চিত অকল্যাণ থেকে রেহাই পাবে।
** মুহাম্মদ আল্-হেলাল, এমফিল গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়