ভোলার পুরাকীর্তি সংরক্ষণের উদ্যোগ জরুরি
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদর থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দক্ষিণে সাঁচরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গুড়িন্দা বাড়িতে সম্প্রতি হাজির হই। সঙ্গে ছিল প্রকৌশলী মেহেদী হাসান ও সদ্য পাস করা আমার সাবেক শিক্ষার্থী প্রকৌশলী শামিল বাসায়েভ। ওই বাড়িতে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এক নান্দনিক প্রাসাদের দেখা পেয়ে আমাদের চক্ষু চরকগাছ। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেলার কয়েক শ বছরের পুরোনো পুরাকীতি!
যাওয়ার আগে ওই প্রসাদের কথা শুনে সিরাজ উদ্দীন আহমেদের বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, অধ্যাপক হোসেন চৌধুরীর ভোলা জেলার ইতিহাস বই দুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। অনলাইনে ভোলা জেলার তথ্য বাতায়ন ঘাঁটাঘাঁটি করি। জেলা তথ্য বাতায়নেও ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি বিভাগে এ ধরনের কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। তবে ইতিহাস বই দুটিতে এর বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এত কাছে থেকেও এ পুরাকীর্তি দেখা হয়নি। সময় করে দুই প্রকৌশলীকে নিয়ে হাজির হই গুড়িন্দা বাড়িতে।
এর চেয়ে পুরোনো কোনো স্থাপনার ইতিহাস ভোলা জেলায় নেই। তৎকালীন সময়ের নির্মাণশৈলী দেখে আমি তো অবাক। সঙ্গের দুই প্রকৌশলীও এর নির্মাণশৈলী দেখে বিস্মিত।
বাড়ির দক্ষিণ ভিটায় প্রাচীন ওই স্থাপত্যের অবস্থান। সামনের অংশে নানা ধরনের নকশা করা। অনেক অংশ দিয়ে পলেস্তারা খসে গেছে। অযত্নে দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে শ্যাওলা পড়ে আছে। প্রবেশদুয়ার একটি। তবে আয়তন উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দুয়ারের প্রস্থ তিন ফুট আর উচ্চতা মাত্র পৌনে ছয় ফুট। ভেতরের দেয়ালে বিভিন্ন নকশা, আল্পনা। বারান্দা থেকে ভেতরের ঘরের দুটি দরজা। আশ্চর্যের বিষয় ওই দরজা দুটির উচ্চতা মাত্র সাড়ে চার ফুট। দেয়াল এবং ছাদে চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালের প্রস্থ কমপক্ষে ২৫ ইঞ্চি। ছাদের প্রস্থও ১০-১১ ইঞ্চি। তবে মেঝে ক্ষয়ে গেছে। পশ্চিম দিক দিয়ে ইট–সুরকির সিঁড়ি সরাসরি ছদের সঙ্গে মিশেছে। ভবনের পেছনের দিকে মাটির সঙ্গে ২-৩টি সুরঙ্গমুখ। সিঁড়িতে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তা দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি ও প্রস্থে ৬ ইঞ্চি। যে কয়টা ইট দেখা যায় সম্পূর্ণ অবিক্রিত। ভেতর-বাহির সব দিকের নির্মাণশৈলী দেখে সঙ্গের দুই প্রকৌশলী এক বাক্যে বলল, ‘শতাধিক বছর আগে কীভাবে এ কাজ করা সম্ভব হয়েছে, তা এক কথায় বিস্ময়কর।’
কথা হয় ওই ঘরের বাসিন্দা আবদুল লতিফের সঙ্গে। তিনি জানান, একসময় তাঁর দাদা আবদুল আজিজ, দাদার ভাই দেলোয়ার হোসেন ও ফজলে করিম একসঙ্গে থাকতেন। তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা আবদুল কাদের ও পরবর্তী ওয়ারিশেরা বসবাস করতেন। এখন স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে তিনি বাড়ির পাশে ঘর করেছেন। এখন দেলোয়ার হোসেনের নাতি ৬৩ বছর বয়সী নান্নু গুড়িন্দা ওই ঘরে থাকেন।
বরিশাল বিভাগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৫৫০ বছর আগে চন্দ্রদ্বীপের (বর্তমান পটুয়াখালীর অংশ) রাজা জয়দেবের ছোট মেয়ে বিদ্যাসুন্দরী ও জামাতা গুড়িন্দার জন্য ওই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। রাজার জামাতা গুড়িন্দা রাজসভার মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী গুড়িন্দা ১৪৭৫ সালের দিকে বিদ্যা সুন্দরীর নামে বিশাল দিঘি খনন করেন। এলাকায় বিদ্যাসুন্দরীর দিঘি নিয়েও নানা কল্পকাহিনি প্রচলিত আছে। (সূত্র: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পৃষ্ঠা-১৪৯) তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরীর ভোলা জেলার ইতিহাস ও এ.বি.এম. আমিনউল্যাহ্র বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা জয়দেব তাঁর মেয়ে বিদ্যাসুন্দরীকে তাঁরই রাজ্যসভার গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে বিয়ে দেন। তাঁর মেয়ে ও জামাতার জন্য ওই রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করেন। রাজার জামাতা গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করার কারণে ওই বাড়ির নাম একসময় গোয়েন্দা বাড়ি ছিল। ধারণা করা হয় জমিদারি প্রথার পর কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে ওই বাড়ির নাম গুড়িন্দা বাড়ি হয়ে যায়।
আমাদের দেশে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের উদ্যোগ খুব একটা লক্ষ করা যায় না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ স্থাপনা একটি জলন্ত দলিল। ইতিহাস ঐতিহ্যের এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করার সরকারি উদ্যোগ জরুরি।
*লেখক: মোবাশ্বির হাসান শিপন, শিক্ষক, সংগঠক