দেশকে মায়ের আদলে দেখে যাওয়া এক রকস্টার

আইয়ুব বাচ্চুসংগৃহীত

ব্যক্তিজীবনে আইয়ুব বাচ্চু যারপরনাই মা-পাগল একজন মানুষ ছিলেন। জীবদ্দশায় বরাবরই মায়ের আগে পরপারে পাড়ি জমানোর আকাঙ্ক্ষা তিনি পোষণ করে গেছেন, কিন্তু বিধাতার ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা। যে কারণে আইয়ুব বাচ্চুর আগেই জীবন নদীর ওপারে চলে যান তাঁর মা। তখন নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনায় পুরোপুরি মুষড়ে পড়েন তিনি। চট্টগ্রামে শেষকৃত্য সম্পাদনের পর মায়ের শূন্য ঘরের খাটটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন এ রকস্টার। বড্ড অভিমানী স্বভাবের অধিকারী আইয়ুব বাচ্চুর জীবনে সেটাই ছিল সবচেয়ে কষ্টের সময়। তিনি বলেছিলেন, ‘ভালো হতো, যদি মায়ের আগে আমি যেতে পারতাম। মা যতটুকু সহ্য করতে পারত, আমি তা পারছি না।’এতেই বোঝা যায় তিনি কতটা মা-ভক্ত ছিলেন!

তা ছাড়া আইয়ুব বাচ্চুর প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই কোনো না কোনোভাবে মায়ের প্রসঙ্গ চলে আসত। এমনকি মাকে নিজের মতো করে ভালোবাসার এবং কোনো দিন কষ্ট না দেওয়ার অনুরোধও ভক্ত-শ্রোতাদের করে গেছেন তিনি জীবনভর।

আসলে মা ছিলেন আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ। তবে মাকে তিনি যতটা ভালোবাসতেন, তার চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসতেন না নিজের দেশটাকে। মায়ের মতো বাংলাদেশেরও স্থান ছিল তাঁর হৃদয়ের গহিনে। দেশমাতৃকার ব্যাপারে সব সময় আপসহীন ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। দেশের কোনো আপমান কোনোভাবেই হজম করতে পারতেন না তিনি। এ প্রসঙ্গে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনাও রয়েছে।

ঘটনাটি ঘটে সেই ১৯৯৮ সালে। তখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে শো করতে যায় এলআরবি। শো শেষ করেই ব্যান্ডের সবাইকে নিয়ে নিউইয়র্ক গিটার সেন্টারে চলে যান আইয়ুব বাচ্চু। সেখানে কাচের বাক্সে থাকা একটি আইভানেজ গিটার নজরে আসে তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে দোকানিকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেন তিনি। জবাব না দিয়ে দোকানির ওলটো প্রশ্ন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?’

আইয়ুব বাচ্চুর উত্তর- বাংলাদেশ।

উত্তরটা শুনেই দোকানি বলে ওঠেন, ‘এটা তোমার মতো বাংলাদেশির জন্য না। এটা অনেক দামি গিটার। তুমি বরং অন্য একটা দেখ।’

কথাগুলো শুনে মন খারাপ করলেন আইয়ুব বাচ্চু, কিন্তু মেজাজ হারালেন না। তিনি দোকানিকে শুধু একবার গিটারটা ধরে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ জানালেন। দোকানিও কীভাবে যেন রাজি হয়ে গেলেন।

গিটারটা হাতে পেয়েই বাজাতে শুরু করেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর গিটারের সুর ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। একটা সময় সেই সুরে মোহাবিষ্ট হয়ে লোকজন জড়ো হয়ে যায় গিটার সেন্টারে। সেদিন আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের সুরে মুগ্ধ হন সেই নাকউঁচু দোকানিও। এ কারণে গিটারটা অর্ধেক দামে বিক্রি করার প্রস্তাব রাখেন তিনি। কিন্তু সে প্রস্তাব মুহূর্তেই নাকচ করে দেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘এটা তুমি আমাকে বিনা পয়সায় দিলেও আমি নেব না। কারণ, তুমি আমার দেশকে অপমান করেছ। যে গিটারের জন্য দেশ অপমানিত হয়, সেই গিটার আইয়ুব বাচ্চু দ্বিতীয়বার বাজায় না।’

এটাই ছিল দেশের প্রতি আইয়ুব বাচ্চুর মমত্ববোধ। এমনকি বেঁচে থাকতে বাংলাদেশকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্নও তিনি দেখেছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নগুলো মূলত গড়ে ওঠত ব্যান্ড সংগীতকে কেন্দ্র করে। তিনি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে রাস্তা বন্ধ করে ১৫ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে একটি ঐতিহাসিক কনসার্ট আয়োজন করার স্বপ্ন দেখতেন, যে কনসার্টে দেশি ব্যান্ড শিল্পীদের সঙ্গে নামকরা বিদেশি শিল্পীরাও একই মঞ্চে বাজাবেন।

আইয়ুব বাচ্চুর স্বপ্নের সেই কনসার্টে ইয়ান পেইস ‘মাধবী’ বা ‘গতকাল রাতে’ বাজাবেন, স্টিভ ভাই ও জো স্যাট্রিয়ানি বাজাবেন ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘দুঃখিনী দুঃখ কোরো না’ ও ‘মন্নান মিয়ার তিতাস মলম’। তাঁদের সঙ্গে মাহফুজ আনাম জেমসকে নিয়ে গিটার বাজাবেন তিনি নিজে। সেই সঙ্গে বেজ বাজাবেন বেজবাবা সুমন এবং কি-বোর্ডে থাকবেন মানাম আহমেদ।

ব্যান্ড সংগীতের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের একটা নতুন পরিচয় তৈরি করার স্বপ্ন সব সময় দেখে গেছেন আইয়ুব বাচ্চু। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত বিদেশিদের মধ্যে ছড়িয়ে সেখানে আমাদের ব্যান্ড সংগীতের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার লক্ষ্যে বিভোর ছিলেন তিনি। তাঁর আজীবনের স্বপ্ন ছিল, বিশ্বমঞ্চে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের মাধ্যমে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করা। আমাদের ব্যান্ড সংগীতের বিশ্বায়নই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে ২০১৫ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি মেটালিকা টিকে থাকে, যদি মেগাডেথ টিকে থাকে, ড্রিম থিয়েটার, স্ক্রিড রো, আয়রন মেইডেন ও আরও বড় যেসব ব্যান্ড রয়েছে, তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশটাও ঢুকে যাবে একই মঞ্চে। আমার মনে হয়, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই তা হয়ে যাবে।’

এভাবেই আইয়ুব বাচ্চুর চিন্তাচেতনাজুড়ে অবস্থান করত বাংলাদেশ, যে দেশটাকে তিনি আক্ষরিক অর্থেই নিজের মায়ের মতো করে দেখতেন।

লেখক: উদয় সিনা, ঘোড়াশাল, পলাশ, নরসিংদী