কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নিঃসঙ্গতা, তারুণ্যশক্তি
মাত্র ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (জন্ম: ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬—মৃত্যু: ২১ জুন ১৯৯১)। প্রেমের কবি, রোমান্টিক কবি। চিরতরুণের কবি। কবিতায় মূর্ধন্য ‘ণ’ বর্জনকারী কবি। সব সময় দন্ত্য ‘ন’ ব্যবহার করেছেন তিনি। প্রেম ও দ্রোহসত্তার বাইরে আর একটি সত্তা আছে, যা নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। তা হলো কবিতায় একাকিত্ব বা একাকিত্ববোধের দারুণ প্রকাশ, গণসমস্যার সৃষ্টিকারীদের প্রতি তীব্র অসন্তোষ। নির্জনতা পছন্দ করতেন। ‘নেই নেই’ অনুভব করতেন। তসলিমা নাসরীনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর আরও একাকী হয়ে যান। কবিতায় তার প্রকাশ দেখি আমরা। সংগ্রামমুখর, নির্জনতা ও একাকিত্ববিষয়ক কিছু কবিতা আলোচনা করে কবির মনোভাব জানার চেষ্টা করব।
তারুণ্য ও বিদ্রোহীর দীপ্ত প্রতীক তিনি। ভালোবাসার টানের কবিতা লেখা শুরু। তাঁর কবিতার মূল বিষয় শোষণ, নিপীড়ন, আগ্রাসন, প্রেম ও দুঃখ-বেদনা। মানুষের আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা, প্রেম, ভালোবাসা, অত্যাচার ইত্যাদিই রুদ্রর কাব্যভাষা। আশির দশকে আধুনিক কবিতায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী কয়েকজন কবির মধ্যে তিনি অন্যতম। উদ্দীপনীয় উন্মুক্ত ও সামাজিক চেতনার ধারণকারী। কবিতায় নতুন কাব্যভাষা ও কাব্যশৈলী নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। রুদ্রর একাকিত্বের কবিতাগুলোও অন্যান্য কবিতার মতো ঝরঝরে। আলংকারিক প্রয়োগ, শব্দ নির্বাচনে নতুনত্ব ইত্যাদি তাঁর কবিতাকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে। শিল্পমান ঠিক রেখে এমন হৃদয়স্পর্শী কবিতা লেখা কঠিন কাজ। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এখানে যথেষ্টই সফল বলে মনে করি। তাঁর সমকালীন অনেক কবির নামের পাশে অনেক বড় বড় পদক শোভা পেলেও জনপ্রিয়তায় তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। জীবিত থাকতে তিনি যতটা জনপ্রিয় ছিলেন, মৃত্যুর পর তিনি তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হন। পঙ্কিল ও অস্থির সমাজকে বদলে দিতে এই ক্ষণজন্মা কবির জন্ম হয়েছিল। তাঁর কবিতা ছিল স্টেনগান আর ছিল অগ্নিশর্মা আবৃত্তিসত্তা। তাঁর রক্তে ছিল চিরতারুণ্য, দ্রোহ।
কবির সময়কার পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক। ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। দুঃখী মানুষের অভাব-অনটনের প্রতি সরকার ছিল অনুদার। সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র ছিল প্রায় নির্বিকার। স্বাধীনতা-উত্তর অস্থিতিশীল সামরিক সময়ের বাস্তবতার নিরিখে কবিতা লিখলেন রুদ্র। ‘বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে/ মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।/...জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।/...স্বাধীনতা—আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল/ ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা (বাতাসে লাশের গন্ধ)’ কবি রুদ্রর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পঠিত কবিতা। বাংলা সাহিত্যেও অন্যতম পঠিত কবিতা।
একাকিত্ব রুদ্রকে গ্রাস করতে চেয়েছে। তসলিমা নাসরীনের সঙ্গে ‘বিচ্ছেদ’ কবির অভিজ্ঞতায় গভীরতা পেয়েছে কবিতাগুলো। ‘সব কথা হয়ে গেলে শেষ/শব্দের প্লাবনে একা জেগে রবো নির্জন ঢেউ,/ভেসে ভেসে জড়াবো নিজেকে(ইচ্ছের দরজায়)’, ‘পথ চলা আমার থাক তোমার থাকুক শুধুই পথ।/আকণ্ঠ গ্লানিরা আমার বেড়ে উঠুক প্রিয়তম ক্ষত/ তোমার থাকুক শুধু শেফালি-সকাল (স্মৃতি বণ্টন)’।
‘মানুষের মানচিত্র’ কবিতায় ১ থেকে ৩২ সংখ্যা পর্যন্ত কবিতা আছে। এ কাব্যের বেশির ভাগজুড়েই রয়েছে অভাব-অনটন, সমাজের সূক্ষ্ম দিকগুলো। ছোট ছোট বিষয় একসময় বড় হয়ে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবন ও সমাজের সূক্ষ্ম ও অতি সূক্ষ্ম বিষয় বা টানাপোড়েন কবিতার প্রাণ হয়েছে। এখানে কবি হিসেবে রুদ্রর দারুণ সফলতা। সংকট ও অভাবের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে রুদ্রর কবিতায় এভাবে, ‘সোয়ামীর ঘর থেকে তালাক হয়েছে তার, জোটেনি তালাক/ জীবনের কাছ থেকে। জীবন নিয়েছে তারে অন্ধকারে টেনে (মানুষের মানচিত্র-১০)’, ‘তুমি যদি কথা দাও কার্তিকের অনটনে দেবে না তালাক,/ তোমার বুকের নিচে আমি তবে ভূমি হবো, হবো এক নদী (মানুষের মানচিত্র-১২)’, ‘যা কিছু হারায় তার কতোটুকু খুঁজেছে মানুষ।/ কতোটুকু পেয়েছে মানুষ।/ সময়ের কীর্তিনাশা দুই কূল ভেঙে চলে গেছে....(একজন উদাসীন)’। সময়কে অস্বীকার না করে আমাদের অস্তিত্বÑমহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বর্ণনাও পাওয়া যায় রুদ্রর অনেক কবিতায়।
লেখক: কবি, ও উপপরিচালক (বিআরডিবি), সাতক্ষীরা