চুরুলিয়ায় হোক ‘বাংলাদেশ ভবন’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুরুলিয়ায় নজরুল বা বাংলাদেশ ভবন করতে পারেন। শান্তিনিকেতনে যেমন বাংলাদেশ ভবন করলেন। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে নিয়ে আসেন, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন। তাই এ আবদার আমরা করতেই পারি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপালের জন্য স্মৃতি ভবন নির্মাণে সহযোগিতা করা গৌরবের বিষয়ই হবে। দুই বাংলার মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আরও অটুট হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে বাংলা সাহিত্য।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্য ভারতে তুলনামূলকভাবে খুব কম উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কিছুটা নেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির একটা জোরালো চাপও আছে। কবির জন্মস্থান চুরুলিয়া অবহেলায় পড়ে আছে। কোনো উন্নয়ন চোখে পড়ে না! বছর কয়েক থেকে কিছুটা উন্নয়ন হচ্ছে। নজরুলের নামে জমকালো মেলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ক্রীড়া-সংস্কৃতির ব্যাপারে সন্দেহাতীতভাবে যথেষ্ট আন্তরিক, সাহিত্য ক্ষেত্রেও। শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন অন্যতম কীর্তি। এবার আর একজন কবি, আমাদের জাতীয় কবির নামে চুরুলিয়ায় বাংলাদেশ ভবন-২ বা অন্য নামে একটা ভবন (মিউজিয়ামসহ) করতে সহযোগিতা করলে আমাদের জন্য মাইলফলক হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের ডালপালা আরও বিস্তৃতি লাভ করবে। নজরুলের জন্মভূমি চুরুলিয়ায় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্কুলের কাছে ফাঁকা জায়গায় এ ভবন নির্মাণে সহযোগিতা করা যেতে পারে।
তার আগে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের গল্প বলি। এটা অনেকেই জানেন। তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে আমরা আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ২০১৮ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় উদ্বোধন করেছেন ভারত আর বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা। অত্যাধুনিক দোতলা এ ভবনে আছে একটি মিলনায়তন, জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। প্রায় ৪৬ হাজার বর্গফুট জায়গার এ ভবন। জাদুঘরটি চালু হচ্ছে প্রায় চার হাজার বর্গফুট এলাকা নিয়ে। আর গ্রন্থাগারের জন্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বই। ভারতে দুষ্প্রাপ্য রবীন্দ্রবিষয়ক ও গবেষণামূলক অনেক বই রাখা হয়েছে। গ্রন্থাগার আর জাদুঘরটিতে রয়েছে অনেকগুলো ইন্টার অ্যাকটিভ, টাচস্ক্রিন কিয়স্ক। রয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা শোনার জন্য অডিও কিয়স্ক। ছাপানো বই ছাড়াও ডিজিটাল বইও পড়তে পারবেন পাঠকেরা। শুরু হয়েছে উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত ২ হাজার ৫০০ হাজার বছর পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন দিয়ে। শেষ হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। মাঝের অনেকটা সময়জুড়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন রয়েছে, তেমনই আছে অতি দুর্লভ কিছু ছবি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন যেমন আছে, তেমনই আছে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের পোড়ামাটির কাজ, ষোলো শতকের নকশাখচিত ইট। রয়েছে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ের নানা নিদর্শন, দেবদেবীদের পোড়ামাটি বা ধাতব মূর্তি। আছে সুলতানি ও ব্রিটিশ শাসনামলও।
জাদুঘরটিতে রাখা নানা প্যানেলে রয়েছে ঢাকার জাতীয় জাদুঘর থেকে আনা বেশ কিছু মুদ্রা। বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ। আছে দেশভাগের ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক যে বিভাগ, তার আগে ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গটি এ কারণে রাখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূচনা তো সেই বায়ান্নতেই। কালানুক্রমিক ইতিহাসের বিভাগ আছে। তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের বাঁকের বিভিন্ন পর্যায়। ছবিতে ধরা রয়েছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যে ঐতিহাসিক মিছিল হয়েছিল, সেখানে গুলি চালানো আর ভাষাশহীদদের প্রসঙ্গ। আছে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পেরিয়ে সত্তরের নির্বাচন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রয়েছে একটি আলাদা গ্যালারি। এতে দেখা যায়, যুদ্ধের সময়কার নানা দুর্লভ ছবি, শরণার্থীশিবির প্রভৃতির ছবি। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিভাগ। শাহজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসরের কাছারির ছবি, সেখানে কবির ব্যবহৃত নানা জিনিসের অনুকৃতি দিয়ে সাজানো রয়েছে জাদুঘরের এ অংশ। কয়েকটি ব্যবহৃত বস্তুও আনা হয়েছে শাহজাদপুর থেকেÑকেরোসিনের বাতি, লবণদানি, খাবারপাত্র। বলা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, আছে প্রত্নতাত্ত্বিক সমারোহ, রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ-স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাংলাদেশের গবেষণার স্মারক। আর পরতে পরতে বাংলাদেশ-সম্পর্কিত ইতিহাস-ঐতিহ্য। তাই বলা যায়, শান্তিনিকেতনের ‘বাংলাদেশ ভবন’কে মিনি বাংলাদেশই বলা যায়। আমাদের সুপারিশ বাংলাদেশ ভবনের আদলে আর একটি ভবন, যা কবিতীর্থ চুরুলিয়ায় করতে হবে। বিষয়-ভাবনা একই থাকতে পারে। একটু ভিন্নতর হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের জায়গায় নজরুলসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ঢুকবে। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব ভাবনাও থাকে প্রায় ক্ষেত্রে।
এ ক্ষেত্রেও থাকবে আশা করি। তাহলে আরও পরিপাটি ও নান্দনিকতা পাবে। বাংলাদেশে কবি নজরুলের অনেক স্মৃতি আছে, গবেষণা আছে। এগুলোর স্মৃতি সে ভবন বা মিউজিয়ামে ধরে রাখা যাবে। আবদার বেশি হলো কি না, জানি না!
কবি নজরুলের অনেক স্মৃতি আছে কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গাসহ বাংলাদেশের অনেক স্থানে। বাংলাদেশের অনেক স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবি নজরুলের নামে। এ সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও কিছু করা যায় কি না, ভাবা যেতে পারে। ভারতে অনেক ট্রেন বা স্টেশনের নাম বিখ্যাত ব্যক্তির নামে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে অনেক ট্রেন বা স্টেশন আছে। একটি মেট্রোরেলের নাম ‘কবি নজরুল’। কিছু ট্রেন বা স্টেশনের নাম নজরুলবিষয়ক করা যায় কিংবা রবীন্দ্রনাথ, ভাষাশহীদদের নামে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের শিলচরের একটি রেলস্টেশনের নাম ভাষাশহীদ করা হয়েছে বলে ফেসবুকে দেখলাম। ঢাকার আন্দোলন, যা এখন বিশ্বদরবারে। কিন্তু ভাষাশহীদদের ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে আছি বলে মনে হয়। বিভিন্ন স্থাপনা ও পাবলিক যানবাহনের নামকরণে এসব বিষয়ে নজর দিতে পারি আমরা। যাত্রী টিকিটেও তুলে ধরতে পারি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশ-জাতি গঠনে ভূমিকা পালনকারীদের তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক