ব্যক্তিপর্যায়ে ফেসবুক ব্যবহার যেভাবে করব

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ফাইল ছবি

প্রথমত, ফেসবুক ইজ নাথিং অফিশিয়াল! এখানে ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবাই সবার বন্ধু! বাপ ছেলের বন্ধু, মা মেয়ের বন্ধু, শিক্ষক শিক্ষার্থীর বন্ধু, বস অধস্তনদের বন্ধু; যেহেতু সবাই সবার বন্ধু, তাই ফেসবুকের সব পোস্ট, কমেন্ট, রিঅ্যাকশন, আলোচনা সবই বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। সুতরাং ফেসবুক ইজ এ ভেরি নাইস প্লেস ফর ফ্রেন্ডশিপ, এখানে বন্ধুর ভালো খবরের পোস্টে লাইক, লাভ, কেয়ার, ওয়াও; ফানি পোস্টে হা হা; খারাপ খবরে স্যাড; এমনকি সামাজিক কোনো অসংগতির খবরে অ্যাংরি রিঅ্যাকশন দেওয়া যেতে পারে!

তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা হচ্ছে মাঝেমধ্যে আমরা বন্ধুত্বের কথাটা মাথায় রাখি না, ফেসবুক যে একটা আনঅফিশিয়াল প্লেস, এটা ভুলে যাই এবং বন্ধু হয়ে বন্ধুকে আক্রমণ করে বসি, এমনকি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করে বসি, যা কোনোভাবেই ফেসবুকের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না, যার ফলে ব্যক্তি সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ফেসবুকে পলিটিক্যাল, ধর্মীয় প্রচারও হয়ে থাকে, মাঝেমধ্যে পলিটিক্যাল ও ধর্মীয় গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে, যা মাঝেমধ্যে সহিংসতায়ও রূপ নেয়।

কীভাবে এই সমস্যা থেকে উত্তরিত হওয়া যায়?

খুবই সহজ! ফেসবুককে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ব্যবহার করতে হবে, অফিশিয়াল ভাবা যাবে না, আক্রমণাত্মক হওয়া যাবে না, গুজব ছড়ানো যাবে না, সর্বোপরি সহিংস হওয়া যাবে না।

ধরেন, কেউ একজন (ফেসবুকে আপনার বন্ধু) তার ওয়ালে একটা পোস্ট দিল, তখন আপনি কী কী করতে পারবেন—

⁃—ভালো লাগলে লাইক দিবেন

⁃—বেশি ভালো লাগলে লাভ দেবেন

⁃ —ফানি পোস্ট হলে হা হা রিঅ্যাক্ট দেবেন

⁃ —খারাপ সংবাদ হলে স্যাড রিঅ্যাক্ট দেবেন

⁃ —অসংগতি মনে হলে অ্যাংরি রিঅ্যাক্ট দেবেন

⁃ —যৌক্তিক কমেন্ট করতে পারেন

কিন্তু কোনোভাবেই এমন রিঅ্যাকশন বা কমেন্ট করা যাবে না, যাতে বিতর্ক সৃষ্টি হয় বা ফেসবুক বন্ধু মনে আঘাত পায়; কারণ, সে আপনার বন্ধু!

কিন্তু ধরেন কোনোভাবেই আপনি তার পোস্টের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না, বা শালীন ভাষায় প্রতিবাদ করেও শান্তি পাচ্ছেন না, খিস্তিখেউড় করতে ইচ্ছা করছে, তাহলে মেসেঞ্জারে চলে যান, প্রাইভেটলি আপনার রাগ প্রকাশ করুন।

ফাইনালি, আপনি তাঁকে আনফ্রেন্ড করতে পারেন, এতে অবশ্য আপনি চাইলে (যদি তাঁর প্রোফাইল পাবলিক করা থাকে) তাঁর প্রোফাইলে ঢুকে তাঁর পোস্ট দেখতে পারবেন, এমনকি তাঁকে পুনরায় ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে পারবেন। তাঁকে ব্লক করে দিতে পারেন, তাহলে আর তিনি বা আপনি কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

সর্বশেষে, আপনি চাইলে তাঁর পোস্টটি সম্পর্কে ফেসবুক অথরিটিকে রিপোর্ট করতে পারবেন। তখন ফেসবুক অথরিটি যাচাই করে ওই পোস্টটির ব্যাপারে ডিসিশন নেবে।

অন্যভাবে যদি দেখি—ধরুন আপনি ফেসবুকে আপনার ওয়ালে একটি পোস্ট দিলেন, তখন অন্যদের রিঅ্যাকশন ও কমেন্টের জবাবে আপনি কী করতে পারেন—কেউ যদি পজিটিভ রিঅ্যাকশন ও কমেন্ট করেন, তাহলে আপনি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন, চাইলে কনভারসেশন চালিয়ে যেতে পারেন যতক্ষণ পর্যন্ত দুজনেই এনজয় করেন।

কিন্তু কেউ যদি নেগেটিভ রিঅ্যাকশন বা কমেন্ট করেন, যা আপনার মনঃপূত নয়, মনে কষ্ট পাচ্ছেন, আপনি অপমানিত ফিল করেন বা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন—তখন আপনি যা যা করতে পারেন—

⁃—সম্ভব হলে এড়িয়ে যান;

⁃—শালীন ভাষায় কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে আপনার অনুভূতি তাঁকে জানান, তিনি যদি পজিটিভলি নেন, তাহলে আপনিও মেনে নিন।

⁃কিন্তু তিনি যদি তাঁর কথায় অবিচল থাকেন, বা আরও অ্যাগ্রোসিভ হন, তাহলে আপনি তাঁকে প্রাইভেটলি মেসেঞ্জারে নক করে আলোচনা করতে পারেন, সমাধান না হলে তাঁর কমেন্টটি ডিলিট করে দিতে পারেন, যেহেতু এটি আপনার ফেসবুক ওয়াল। তাতেও কাজ না হলে আপনি তাঁকে আনফ্রেন্ড করতে পারেন, এতে অবশ্য আপনি চাইলে (যদি তাঁর প্রোফাইল পাবলিক করা থাকে) তাঁর প্রোফাইলে ঢুকে তার পোস্ট দেখতে পারবেন, এমনকি তাঁকে পুনরায় ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে পারবেন। আর যদি মনে করেন, তাঁর সঙ্গে আর ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ কন্টিনিউ করা সম্ভব নয়, তাহলে তাঁকে ব্লক করে দিতে পারেন, তাহলে আর তিনি বা আপনি কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

আরেকটা বিষয় ফেসবুক সুযোগ রেখেছে, সেটা হচ্ছে প্রাইভেসি সেটিংস। আপনি চাইলে কনটেন্ট অনুসারে বিতর্ক এড়ানোর জন্য আপনি আপনার পোস্টটি পাবলিক না করে শুধু ফ্রেন্ডদের জন্য, এমনকি শুধু নির্দিষ্ট কোনো একজন/কয়েকজন ফ্রেন্ডের জন্যও সেট করে দিতে পারেন। তাতে অন্তত বিতর্ক হলেও নিজেদের মধ্যেই হবে, পাবলিকলি নয়। এতেও যদি আপনি সন্তুষ্ট না হন, তাহলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ ভালোভাবে জেনে নিয়ে যা করার নিজ দায়িত্বে করেন।

যদিও আমার লেখার শিরোনামেই বলেছি যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে এই লেখা, তবু পাবলিকলি ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে দু–একটা কথা না বললেই নয়। ফেসবুক এখন রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ও আরও নানা কাজে দেদার ব্যবহার হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ব্যবহারের নর্মসও বিভিন্ন রকম হবে। উদাহরণসরূপ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের পাবলিক ফেসবুক প্রোফাইল আছে, সেখানে উনারা অনেক রাজনৈতিক পোস্ট দেন, সেসব পোস্টে লাইক, লাভ রিঅ্যাক্ট যেমন পড়ে; হা হা, অ্যাংরি রিঅ্যাক্টও অনেকেই দেন, ভালো ভালো কমেন্ট যেমন থাকে, গালিগালাজও অনেক ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে নর্মস কেমন হওয়া উচিত?

দুজন অভিনেতা বা সেলিব্রেটির ফ্যানদের মধ্যে মাঝেমধ্যে ফেসবুকে কাদা–ছোড়াছুড়ি হতেও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেই বা নর্মস কী হবে?

অনলাইন ব্যবসার বড় একটি প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক। সেখানেও ভালো প্রোডাক্টের বিষয়ে পজিটিভ মন্তব্য যেমন আছে, মাঝেমধ্যে প্রোডাক্ট নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে অনেককে খিস্তিখেউড় করতেও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নর্মস কী হবে?

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া পোস্ট নিয়ে তো মারামারি পর্যন্ত গড়ায়! যেকেউ তার নিজের ধর্ম নিয়ে পোস্ট দিতেই পারেন, কিন্তু সেটা যাতে কোনোভাবেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত না করে, তা সর্বোতভাবেই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

সবশেষে আবারও বলতে হয়, ফেসবুক ইজ নাথিং অফিশিয়াল! এখানে ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবাই সবার বন্ধু! তাই এমন কথা বলা যাবে না, যা বন্ধুকে কষ্ট দেয়, বন্ধুত্ব নষ্ট করে! একটা কথা আছে, তোমার শত্রুকে এক হাজার সুযোগ দাও বন্ধু হওয়ার, কিন্তু বন্ধুকে একটা সুযোগও দিও না শত্রু হওয়ার।

*লেখক: মোহাম্মদ শামসুর রহমান, অধ্যাপক ও গবেষক, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়