নারী ও শিশু শ্রমিক: পুঁজি যদি তাদের ঘাম চায়, তবে রাষ্ট্রকে দিতে হবে মর্যাদা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের নারী ও শিশু শ্রমিকদের স্বপ্ন বরাবরই শিকলে বন্দী। তাদের দুঃখগাথা নিয়ে কার্যকর কিঞ্চিৎ কথা বলার মানুষও এই পরগনায় আমরা এখনো দেখিনি। তারা সমাজের প্রান্তিক প্রান্তরে লুকিয়ে থাকা সেই মুখ, যাদের ঘাম লেগে আছে আমাদের পোশাকের সেলাইয়ে, ইটভাটার ধুলায় কিংবা গৃহস্থালির নিঃশব্দ দায়িত্বে।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু শ্রমিকেরা এক অনুচ্চারিত বেদনার প্রতীক, যাদের জীবন যেন পুঁজিবাদের এক নির্মম উপাখ্যান। দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৬ শতাংশই নারী, যাদের বড় অংশ কর্মরত রয়েছে পোশাকশিল্পে। এই শিল্প খাত দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ জোগালেও, নারী শ্রমিকদের গড় আয় ১২ হাজার ৫০০ টাকার নিচে। অথচ তাঁদের শ্রমঘণ্টা পুরুষদের চেয়েও বেশি, ছুটির দিনও অনিশ্চিত। মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ কিংবা যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা—সবই অনেকটা বিলাসিতার মতো।

শ্রম আইনের কাগুজে সুরক্ষার বিপরীতে বাস্তবতার গল্প ভিন্ন। নারী শ্রমিকেরা কাজের জায়গায় প্রায়ই সম্মানহানি ও নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হন।

শিশুদের অবস্থা আরও শোচনীয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনো প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। যারা কাজ করছে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে—চামড়া কারখানা, ইটভাটা, প্লাস্টিক বা কাচশিল্প, গ্যারেজ, গ্রিল মেকিং ও ঝালাই, গৃহকর্ম কিংবা রাস্তার দোকানে।

তাদের নেই নির্ধারিত মজুরি, নেই শিক্ষা, নেই বিনোদন। কাঁধে সংসারের বোঝা চাপিয়ে, তারা হারিয়ে ফেলে শৈশবের রং। শিশু শ্রমিকদের অনেকে অপুষ্টি, রোগ ও মানসিক অবসাদের শিকার। শহরের প্রাচুর্যের নিচে দিনের পর দিন তারা রয়ে যায় অদৃশ্য, উপেক্ষিত।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

এই বাস্তবতা যখন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে, তখন উন্নত ও সভ্য বিশ্বে দৃশ্যটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রগুলো, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো নারী ও শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষায় কঠোর ও মানবিক আইন প্রণয়ন করেছে।

সুইডেনে নারী শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ৪৮০ দিনের পিতৃ বা মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকে, যা মা ও বাবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়া বাধ্যতামূলক। জার্মানিতে গর্ভাবস্থায় কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা ও মাতৃত্বকালীন ছুটির পর চাকরি ধরে রাখার বিধান কঠোরভাবে পালিত হয়। নরওয়েতে শ্রমিকদের জন্য কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন, পরিবারবান্ধব কর্মঘণ্টা ও শিশু পরিচর্যা–সুবিধা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিশ্চিত করা হয়।

শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণে উন্নত বিশ্বে ১৪ বছরের নিচে কাউকে শ্রমে নিয়োগ করলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং কড়া নজরদারি থাকে। ILO কনভেনশন 138 ও 182 ধারা মোতাবেক শিশুশ্রমের বয়সসীমা ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেশির ভাগ উন্নত দেশ তা স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করেছে কার্যকরভাবে।

বাংলাদেশেও এই কনভেনশনগুলোতে স্বাক্ষর করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের ইচ্ছাশক্তি ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে আইন রয়ে গেছে শুধু কাগজে-কলমে।

বাংলাদেশের পুরুষেরা নারী সহকর্মীকে অধস্তন হিসেবে দেখেন। যোগ্যতম নারীকে পুরুষেরা ভয়ানকভাবে ঈর্ষা করেন। ছলে–বলে কূটকৌশলে নারীর ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে পুরুষেরা অস্বীকার করতে চান। নারী যদি প্রকৃতিগতভাবেই অবয়বে দেখতে সুশ্রী হন, তবে তাঁর জ্বালা আরও বেশি। পুরুষের লোলুপদৃষ্টি ও মনোবিকার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলাটা ভয়ানক কঠিন কর্ম হয়ে ওঠে। এত সব প্রতিবন্ধকতা সয়েও নারী কাজ করে যান নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর কাজের স্বীকৃতি পুরুষের কাছে খুব কমই জোটে।

নারী ও শিশু শ্রমিকদের প্রতি এই অবহেলা শুধুই মানবিক ব্যর্থতা নয়; এটি আমাদের উন্নয়নের নৈতিক কাঠামোকেই দুর্বল করে। উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। নারী শ্রমিকদের জন্য প্রসূতি–সুবিধা, নিরাপদ পরিবেশ, সমান মজুরি এবং শিশুদের জন্য শিক্ষা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা নিশ্চিত না করে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ গড়া সম্ভব নয়।

রাষ্ট্র যখন উন্নয়নের গৌরবগাথা উচ্চারণ করে, তখন তার কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া উচিত নারী ও শিশু শ্রমিকদের জীবনের সত্য কাহিনি। এই মুখগুলো শুধু দয়া নয়, চায় অধিকার। পুঁজি যদি তাদের অমূল্য ঘাম চায়, তবে রাষ্ট্রকে দিতে হবে যথোচিত মর্যাদা।