আধিপত্য নয়, সৌহার্দ্য: নারী-পুরুষের অংশীদারত্বের মডেল
আজ মহীয়সী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিবসে তাঁকে স্মরণ করছি।
একবিংশ শতাব্দীতে নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজি, সিডও এবং আইএলও কনভেনশনের এজেন্ডাগুলো একীভূত করে কর্মপরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়নসহ নানা প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তৎপর। সময়ের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সত্যিই বড্ড আফসোস হচ্ছে এই ভেবে যে আমাদের সমাজে এক শতাব্দীর বেশি আগে এক অনন্য নৈতিকতাবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস নিয়ে যে নারীর আত্মপ্রকাশ হয়েছিল, তাঁর সব প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সমাজকর্মের মর্মবাণী যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম, তাহলে হয়তো এসব বৈশ্বিক বাধ্যবাধকতা পালনের প্রয়োজনীয়তা আজ উপলব্ধ হতো না। তিনি আর কেউ নন, তিনি মহীয়সী বেগম রোকেয়া, যিনি সমাজের প্রতিবন্ধকতাগুলো পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা করে যেসব সংস্কারের পরামর্শ তাঁর ভ্রাতা ও ভগ্নিদের জন্য পেশ করেন বা এমন এক সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্পনা করেন, যা লিঙ্গসমতা, সামাজিক ন্যায়, টেকসই উন্নয়ন এবং অগ্রগতির আলোচনায় আজও প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রেরণামূলক। তাঁর সব প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সমাজকর্মে নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য তিনি শুধু পুরুষদের এককভাবে দায়ী করেননি, নারীদেরও সমানভাবে দায়ী করেছেন। তাঁর সব লেখনী ও সাহিত্যকর্মের মধ্যে তিনটি বিষয় বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। তা হলো—
১. পুরুষ শারীরিক বল দেখিয়ে নারীর ওপর আধিপত্য করবেন না; বরং সহযোগিতা করবেন;
২. নারী মূর্খতা, অক্ষমতা, দুর্বলতা ও ভয় থেকে বেরিয়ে এসে সুশিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পুরুষের সমকক্ষ হবেন এবং
৩. নারী ও পুরুষ সমভাবে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবেন।
বেগম রোকেয়া যুক্তি দিয়ে দেখান যে নারী ও পুরুষ—উভয়েরই শক্তি, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। আর এই ভিন্নতার সমন্বয়ে পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজকে আরও স্থিতিশীল, সৃজনশীল ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধে কাল্পনিক নারীস্থানে নারী-পুরুষের মধ্যে যাবতীয় কঠিন পরিশ্রম ও মস্তিষ্ক চালনার মতো শ্রম বণ্টনের মাধ্যমে অংশীদারত্বের নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে সেই নৈতিক অংশীদারত্বের পরিবর্তে ক্ষমতার গতিশীলতা এখনো পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, সরকারে, বাণিজ্যে এবং আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, হত্যাসহ পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আজও রাজপথে বিভিন্ন বয়সী নারীদের প্রতিনিয়ত সমাবেশ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া যৌতুক, তালাক ও নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা দেখায় যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর আধিপত্য এখনো বলবৎ। বর্তমান পরিসংখ্যান নিজেই এর পক্ষে কথা বলে। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন, যৌতুক নিরোধ, বাল্যবিবাহ নিরোধ, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে আইন হয়েছে এবং কার্যকর বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। কিন্তু আমরা একবারও চিন্তা করে দেখছি না যে পরিবারের সদস্যদের আচার–আচরণ ও সামাজিক মনোভাব সরকারি বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা নির্ধারণ করা এবং সেগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করবে বলে আশা করা কতখানি যৌক্তিক, যতক্ষণ না সমাজ বা পরিবারের সদস্যদের সেই মনোজাগতিক চিন্তাচেতনার উন্নয়ন হয়। এ জন্যই মহীয়সী বেগম রোকেয়া সমতা ও যৌথ অগ্রগতির আহ্বানের মধ্য দিয়ে পরিবারে নারী-পুরুষের সম্পর্কের এক নতুন নৈতিক ভিত্তি স্থাপন করেছেন, যেখানে আধিপত্য নয়, বন্ধুত্বই মূল।
সমতার ভিত্তি হিসেবে বন্ধুত্ব—
বেগম রোকেয়ার দুটি উক্তি: ‘পাত্র-পাত্রীর সম্মতিতে বিয়ে হলে উভয়ের সম্মতিতে তালাক হবে কিন্তু একতরফা হবে না’ এবং ‘বয়স্ক পুরুষ কোমলমতি নারীকে বিয়ে করতে পারবে না’ (নারীর অধিকার)। এর মাধ্যমে পারস্পারিক শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব ও সমতার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। এটি শুধু আইনি স্বীকৃতির দাবি নয়; বরং নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমতার ঘোষণা। কিন্তু আমাদের সমাজে পুরুষের প্রভুত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বিদ্যমান। গ্রামীণ সমাজে এখনো বেশির ভাগ স্বামী মনে করেন, তিনি স্ত্রীর চলাফেরা, টাকা বা সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাখেন, হুমকি দিতে পারেন বা স্বাধীনতা সীমিত করতে পারেন। অনেক পুরুষ এখনো মনে করেন, মেয়েটির পরিবার থেকে আরও পণ দাবি করা যায়, না পেলে নির্যাতন বা হত্যা পর্যন্ত করা যায়। কর্মক্ষেত্রে একজন পুরুষ তত্ত্বাবধায়ক ক্ষমতার অপব্যবহার করে নারী কর্মীকে হেনস্থা করেন বা যৌন–সুবিধার জন্য চাপ দেন। অনেক মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়; কারণ, বাবা মনে করেন, তিনিই কন্যার জীবনের সিদ্ধান্ত নেবেন। নারীদের চুপ করিয়ে রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাঁদের ব্ল্যাকমেল, অনলাইনে হুমকি বা অপমান করা হয়। স্বামী স্ত্রীকে ঘরের বাইরে কাজ করতে বাধা দেন, তাঁর উপার্জন কেড়ে নেন বা টাকা দিয়ে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সমাজের এসব উদাহরণ আধিপত্য বিস্তারের নমুনা। কাজেই যেসব পুরুষ পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে অংশীদারত্বের মডেল হওয়ার সাহস রাখেন, তাঁরা বেগম রোকেয়ার শক্তিশালী সাহিত্যকর্ম থেকে আজও তাঁদের নৈতিক মূল্যবোধকে গঠন করতে পারেন এবং পুরুষত্বের সুস্থ রূপগুলোকে প্রচার করতে পারেন। পুরুষেরা নারীর প্রতি আধিপত্য নয়; বরং সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব ও আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁদের চারপাশের ছেলে, যুবক ও অন্য পুরুষদের ওপর যেভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে বা উৎসাহিত করতে পারেন, তার কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
সমাজে বাবা মেয়ের ২১ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের কথা চিন্তা না করে চিকিৎসা, প্রকৌশল, গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত ও সহায়তা করবেন;
স্বামী তাঁর স্ত্রীর অনলাইন ব্যবসায় পণ্য সরবরাহ, প্যাকেজিং, ডেলিভারি ও অর্ডার ব্যবস্থাপনায় কায়িক শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করবেন। স্ত্রীর প্রজননস্বাস্থ্য বা পরিবার পরিকল্পনায় সক্রিয় অংশগ্রহণসহ পুষ্টি ও গর্ভকালীন যত্ন বিষয়ে সচেতনতা সেশনে স্ত্রীর সঙ্গী হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন, পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে ঘরে শিশু পালন এবং পরিবারের যত্ন ও গৃহস্থালি কাজের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবেন;
বেগম রোকেয়াকে সাধারণত নারীজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ তিনি বিংশ শতাব্দীর সেই সমাজের পুরুষদের এমন কিছু আচরণ এবং ভূমিকার বিষয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন, যা পুরুষ, যুবক ও ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্কিত।
পুরুষ ও যুবকেরা রাস্তাঘাটে বা বাসে নারী ও কন্যাশিশুদের হয়রানি করা দেখলে, কন্যাদান বা নাবালিকার বিয়ে হতে দেখলে এবং পরিবারের সদস্যরা সহিংস সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে ভাই বা পুরুষ আত্মীয়রা পারিবারিক মর্যাদাকে প্রধান্য না দিয়ে ভুক্তভোগীকে থানায় বা লিগ্যাল এইডে যেতে বা ডিএনএ পরীক্ষাসহ চিকিৎসাসহায়তা পেতে তাৎক্ষণিক ৯৯৯ ও ১০৯ নম্বরে ফোন করবেন;
পুরুষ কর্মকর্তারা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরিসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি, মাতৃদুগ্ধ পান করানো এবং শিশুযত্ন কক্ষ ব্যবহারে প্রকাশ্যভাবে সমর্থন করবেন;
পুরুষেরা লিঙ্গসমতার একটি রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আরও দক্ষ, যোগ্য ও সুশিক্ষিত নারীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সক্রিয় হয়ে কথা বলবেন বা কাজ করবেন;
পুরুষেরা রাষ্ট্রের বিচার, প্রশাসন ও নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের উচ্চপর্যায়ে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের দায়িত্বে দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন।
অগ্রগতি মানে যৌথ উন্নতি—
বেগম রোকেয়ার উক্তি: ‘জগতের যে সকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছেন, তাঁহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন’ (স্ত্রীজাতীর অবনতি) বোঝায় যে যখন নারী-পুরুষ সমানভাবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশ নেয়, তখন সত্যিকারের উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়। গবেষণা, বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বৈশ্বিক নীতিগত কাঠামো—সবই এই উক্তিকে শক্তভাবে সমর্থন করে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে নারীরা পুরুষের মতো সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়ে আছে। একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের উন্নয়ন পরিসংখ্যানগুলো একই চিত্র প্রদর্শন করে। যেমন বাংলাদেশে প্রকৌশল, গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় নারী মাত্র ২০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পুরুষ ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ; শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পুরুষের ৮০ শতাংশ; ব্যবস্থাপক পদে নিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে নারী ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পুরুষ ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ; অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারী ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও পুরুষ ৭৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নারীরা পুরুষদের তুলনায় প্রতিদিন প্রায় ৭ গুণ বেশি ঘণ্টা অবৈতনিক যত্ন ও গৃহস্থালির কাজে ব্যয় করেন। এই পরিসংখ্যান শিক্ষা, শ্রম ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে একটি বিশাল লিঙ্গবৈষম্য প্রদর্শন করে এবং যৌথ অগ্রগতির ভারসাম্যহীনতা তুলে ধরে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বিংশ শতাব্দীতে যেখানে বেগম রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধে ‘একুশ বৎসর বয়ঃক্রমের পূর্ব্বে কোন কন্যার বিবাহ হইতে পারিবে না’ এই কাল্পনিক বিধির প্রস্তাব করেন, সেখানে একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন–২০১৭তে নারীর বিবাহের বয়স ১৮ বছর এবং পুরুষের ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো অনেক কন্যা ১৮ বছরের আগেই এবং উল্লেখযোগ্য অংশ ২০ বছরের আগেই বিবাহিত হয়। ২১ বছরের আগে নারীর বিবাহের বৈজ্ঞানিক ও পরিসংখ্যানভিত্তিক ক্ষতিকর অনেক প্রমাণ রয়েছে। যেমন প্রজনন স্বাস্থ্য পূর্ণ পরিপক্ব নয় বিধায় মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বেশি; মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পূর্ণ বিকশিত নয় বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দুর্বল, বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ সামলানোর ক্ষমতা কম; নিজের মত প্রকাশে অসুবিধা হওয়ার ঝুঁকি; শিশুমৃত্যু ও কম ওজনের শিশু জন্মের ঝুঁকি; শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের স্বপ্ন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি এবং দারিদ্র্যের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া গবেষণা ও পরিসংখ্যান দেখায় যে ২০ বছরের আগে বিবাহিত নারীরা তিন গুণ বেশি ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হয়, যা জাতীয় উন্নয়ন ও এসডিজি অর্জনকেও বাধাগ্রস্ত করে। এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্ট করে যে বাংলাদেশ এখনো বেগম রোকেয়ার বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক আইন প্রণয়নের চিন্তা থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে।
নারী শিক্ষার বিষয়ে তিনি ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘রমণীর জন্য আজ পর্যন্ত যেসব কর্তব্য নির্ধারিত আছে, তাহা সাধন করিতেও বুদ্ধির প্রয়োজন’ এবং ‘শিশু-পালন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য বিশ বছর বয়সের আগে কেউ বিয়ে করবে না এবং মায়ের দায়িত্ব না জেনে কেউ মা হবে না, মেয়েদের ভালোভাবে পড়াশোনা শেখানো দরকার, যাতে তারা তাদের শরীরের যত্ন নিতে পারে।’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে নারীর দায়িত্ব কখনোই শুধু প্রথাগত বা যান্ত্রিক নয়; বরং নির্ধারিত কাজটি করতে যে জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও মানসিক সক্ষমতার প্রয়োজন, তা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের কোনো একটি গ্রামীণ অঞ্চলে বন উজাড় হয়ে গেছে। এখন গ্রামীণ বন সম্পদ ব্যবস্থাপনায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণের প্রস্তাব করা হলো। কারণ হিসেবে বলা হলো, যেহেতু গ্রামীণ নারীরা জীবিকা নির্বাহের চাহিদা পূরণের জন্য জ্বালানি কাঠ, গাছের শুকনো পাতা, গাছের সবুজ ডালপালা, পশুখাদ্য ও অন্যান্য বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল এবং অন্যদিকে পুরুষরা বাসস্থান তৈরির জন্য বনজ কাঠ ও বাঁশের ওপর নির্ভরশীল—এ জন্য তাদের মতামত প্রয়োজন। কাজেই সে অঞ্চলের বন ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ইউপি নারী সদস্যসহ গ্রামীণ অন্য নারীদের সম্পৃক্ত করা হলো। গ্রামীণ বনসম্পদ সংরক্ষণ ও বনজ পণ্যের টেকসই ব্যবহারের জন্য উক্ত নারীদের যদি পশুখাদ্য, জ্বালানি কাঠ ও নির্মাণ কাঠের ঘাটতি হ্রাসের জন্য বিকল্প শক্তি ও বিকল্প পণ্যের উৎস জানা না থাকে; বিভিন্ন বনজ পণ্যের চাহিদা জানা না থাকে; বন প্রজাতির বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে এবং বনের জৈব-ভৌত বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে মাটিতে পড়া পতিত গাছ, ডালপালা, শুকনো কাঠ এবং পাতার আবর্জনা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা জানা না থাকে এবং বনের বিভিন্ন স্তরের জন্য গাছ, গুল্ম, ঘাসের বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা ও শতকরা পরিমাণ জানা না থাকে, তাহলে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব স্থানীয় পর্যায়ে বনসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নারীদের সফল অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং সঠিক দায়িত্ব পালন বা কাজ করার জন্য অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন নারীদের প্রয়োজন, যা বেগম রোকেয়া তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বারবার স্মরণ করে দিয়েছেন। নারীশিক্ষায় সহায়তা করার জন্য তিনি পুরুষদের উদ্দেশে আরও বলেছেন, ‘ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই—তাঁহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ–মুক্তার অলংকারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলংকৃতা করিতে চেষ্টা করিবেন।’ (বোরকা)।
যদি নারীরা আরও বেশি শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ–সুবিধা পেয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, তাহলে পরিবারের মোট আয় বাড়ে; নারী-পুরুষ উভয়েই দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে; শিশুদের শিক্ষা ও পুষ্টি উন্নত হয়; নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়; কৃষি, গার্মেন্টস, হস্তশিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় নারীর অবদান জাতীয় উৎপাদন ও বাজারকে শক্তিশালী করে; জাতীয় মানবসম্পদ শক্তিশালী হয়; নারীর অংশগ্রহণে শাসনব্যবস্থা, জবাবদিহি ও নীতিনির্ধারণ আরও উন্নত হয় এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি বড় হয়, উৎপাদনশীলতা ও জিডিপি বাড়ে। এ তথ্য নির্দেশ করে যে নারীর উন্নতি আসলে পুরো সমাজের উন্নয়নকে শক্তিশালী করে। উদাহরণস্বরূপ নর্ডিক দেশগুলো (সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক) বিশ্বের শীর্ষে জিডিপি প্রতি মাথাপিছু আয় এবং উৎপাদনশীলতায় অবস্থান করছে। কারণ, সেখানে সংসদে ও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দারিদ্র্যের হার সর্বনিম্ন। সুতরাং সত্যিকারের উন্নয়ন তখনই দৃশ্যমান হয়, যখন নারী-পুরুষ সমানভাবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশ নেয় এবং সমানভাবে এগিয়ে যায়, যা বেগম রোকেয়ার বিশ্বাসের প্রতিফলন।
পরিশেষে বলা যায়, বেগম রোকেয়াকে সাধারণত নারীজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ তিনি বিংশ শতাব্দীর সেই সমাজের পুরুষদের এমন কিছু আচরণ এবং ভূমিকার বিষয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন, যা পুরুষ, যুবক ও ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি প্রায় ১২ দশকের বেশি সময় আগে পরিবারে পুরুষদের মানসিক উন্নয়নের মাধ্যমে আধিপত্য ছাড়াই নারীদের সঙ্গে আরও নমনীয়, সহানুভূতি এবং সহযোগিতা করার ওপর জোর দেন, যা এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গেও সম্পর্কিত। এ ছাড়া তিনি বন্ধুত্ব ও যৌথ অগ্রগতির আহ্বানের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের এক আধুনিক মডেল স্থাপন করেন, যেখানে আধিপত্য নয়, সৌহার্দ্যই অংশীদারত্বের মূল। তাঁর উক্তি, ‘পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে—একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।’ (স্ত্রীজাতির অবনতি)। আজও সমাজের উন্নয়নে নারী-পুরুষের স্বার্থ, উদ্দেশ্য ও অধিকার যে একসূত্রে গাঁথা, তা দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করে। তাঁর পুরুষকেন্দ্রিক আদর্শ দিকনির্দেশনা বর্তমান সময়, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর এখনো প্রভাব ফেলতে পারে বিধায় যা আজও আলোচনার বিষয়। কাজেই তিনি শুধু নারীজাগরণের অগ্রদূত নন, পুরুষ জাগরণেরও অগ্রদূত।
বেগম রোকেয়ার বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে নির্মিত অংশীদারত্বের এই মডেল বুঝতে একটা জাতির সব নারী-পুরুষ শুধু সাক্ষরতা অর্জন করলেই হবে না; বরং তাঁর লেখনীর মর্ম বুঝতে হলে বা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করতে হলে পরিবারের সদস্যদের কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিসংখ্যান দেখায় যে মাত্র ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ নারী এবং ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ পুরুষ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ নারী এবং ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ সাক্ষরতা অর্জন করেছে, যা বেগম রোকেয়ার উক্ত মডেল বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট নয়। একটা সরল সমাধান, যা আমরা কি কখনো কল্পনা করেছি, আর তা হলো যদি নারী ও পুরুষের জন্য ১২ বছর অবৈতনিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হতো এবং বিভিন্ন স্তরের পাঠ্যক্রমে বেগম রোকেয়ার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’, অর্ধাঙ্গী’, ‘বোরকা’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘নারীসৃষ্টি’, ‘গৃহ’, ‘শিশু-পালন’, ‘নারীর অধিকার’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ আবশ্যিক করা হতো, তাহলে হয়তো জাতি আজ লিঙ্গবৈষম্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক বেশি উপকৃত হতো। তিনি এসব প্রবন্ধে আধিপত্যকেন্দ্রিক ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও যৌথ দায়িত্ববোধের মাধ্যমে সামগ্রিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার কথা বলেছেন, যা আধুনিক বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক অগ্রগতির জন্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি।
মহীয়সী বেগম রোকেয়াকে আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে, কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁর সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সমাজ সংস্কারের পথনির্দেশনার জন্য। প্রত্যাশা রইল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে, তারা বেগম রোকেয়ার সাহিত্য ও প্রবন্ধগুলো পড়বে এবং তাঁর দিকনির্দেশনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলবে, যেখানে সবাই সমান মর্যাদায় বিকশিত হবে, আর অগ্রগতি হবে সত্যিকার অর্থে সমষ্টিগত।
*লেখক: শবনম মোস্তারী: অতিরিক্ত সচিব, শিশু ও সমন্বয় অনুবিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।