মোঘল আমলের ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায়, এক অনন্য অনুভূতি
১. ছোটবেলায় যখন গ্রামে দাদা বাড়িতে ঈদ করেছি, তখন ঈদগাহে নামাজ পড়ানো হতো। তরুণ বয়সে যখন নিজ আবাসস্থলে ঈদ করেছি, তখনও ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়েছি। এখনো গ্রামে ঈদের নামাজ বলতে ঈদগাহে নামাজ আদায় করা হয়। ঢাকায় ঈদের নামাজ সাধারণত ঈদগাহে আদায় করা হলেও কালের পরিক্রমায় জনসংখ্যায় আধিক্যজনিত কারণে মসজিদেও ঈদের নামাজ পড়ানো হয়ে থাকে। আমি রাজধানী ঢাকায় মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেছি। এবারে চাঁদ রাতে হঠাৎ মনে হল, এবার মসজিদে নয়; ঐতিহ্যবাহী কোন ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। ঢাকায় ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহের চেয়ে ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ আছে কি?
২. ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে গোসল সেড়ে হাল্কা মিষ্টিমুখ করে রওনা দিলাম অভিষ্ঠ লক্ষে। মোহাম্মদপুর বাস্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে ধানমন্ডি ঈদগাহের কাছে নামলাম। দেখলাম মুসল্লিরা দল বেঁধে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাচ্ছে। আমিও তাদের সাথে যুক্ত হলাম। খুব কম সময়ে ঈদগাহ ময়দানে চলে এলাম। তখন ঘড়ির সময় সকাল সাতটা বেজে পনের মিনিট।
৩. নামাজ শুরু হবে সকাল আটটায়। মাইকে ধর্মীয় আলোচনা চলছে। এর ভেতরে আমার দুই পাশে বসা দুইজনের সাথে আলাপ-পরিচয় হল। হুজুরের বয়ান শুনে বুঝতে পারলাম, ঈদগাহ কেন্দ্রীক মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। সংসদ সদস্য (ঢাকা-১০) ফেরদৌস আহমেদ আজ এই ঈদ মাঠে নামাজ আদায় করেছেন। তাঁর বক্তব্যর পরেই হুজুর ঈদুল ফিতরের নামাজ শুরু করলেন। ফেরদৌস আহমেদ স্থানীয় সংসদ সদস্য হওয়ায় তাঁকে ঘিরে নামাজের পরে বেশ ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। ঈদের নামাজ ও কোলাকুলি করার পরে আমার মনে হল, ঈদগাহ, মাদ্রাসা ও মসজিদ ঘুরে দেখা দরকার। ঈদগাহ মোঘল সাম্রাজ্যের আমলে নির্মিত হলেও মাদ্রাসা ও মসজিদ অনেক পরে নির্মাণ করা হয়েছে। ঈদগাহ প্রাংগনে ঈদের নামাজের স্থান সংকুলান না হলে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
৪. ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ ঢাকার ধানমন্ডি থানার একটি প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। ১৬৪০ সালে বাংলার সুবাদার সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার প্রধান দেওয়ান মীর আবুল কাসেম ধানমন্ডির শাহী ঈদগাহ নির্মাণ করেন। ঢাকায় অবস্থিত মুঘল স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম ধানমন্ডি ঈদগাহ। ঈদগাহ বর্তমানে ঈদের নামাযের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮১ সাল থেকে ধানমন্ডি ঈদগাহ সংরক্ষণ করে আসছে । এখনো এখানে ঈদের নামাজের উপযোগিতা রয়েছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এখানে নামাজ পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করে। প্রায় ৪০০ বছরের কাছাকাছি বয়সের ঈদগাহে একসাথে আড়াই হাজার মানুষ ঈদের নামাজ পড়তে পারে। ঈদের নামাজের বাইরে এটা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
৫. তৎকালীন সময়ে ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ মুল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল। মূল শহর, অর্থাৎ পুরনো ঢাকায় বেশ কয়েকটি সুলতানি ঈদগাহ থাকলেও বড় আকারে কোন ঈদগাহ ছিল না। মীর আবুল কাসেম ঈদগাহের জন্য জায়গা খুঁজতে থাকে। মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় এবং সাত গম্বুজ মসজিদের কাছে হওয়ার কারণে ধানমন্ডি এলাকাতে ঈদগাহটি নির্মিত হয়। সে সময় সাত গম্বুজ মসজিদে জল ও স্থলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল। ঈদগাহের পাশ দিয়ে অতীতে পান্ডু নদীর একটা শাখা প্রবাহিত হত, যা সাত মসজিদের কাছে বুড়িগঙ্গার সাথে মিলিত হয়। পান্ডু নদী কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
৬. ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহের দৈর্ঘ্যে ১৪৫ ফিট ও প্রস্থে ১৩৭ ফিট। ৪ ফিট উচু করে ঈদগাহ নির্মিত হয়, যাতে বন্যায় ক্ষতি না হয়। এর চারকোণে অষ্টাভূজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। তিন ধাপের মিম্বর ঈদগাহের উত্তর পাশে রয়েছে, এখানে দাঁড়িয়ে ইমামরা নামায পড়ান। ঈদগাহ চারদিকে ১৫ ফিট উচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বর্তমানে শুধু পশ্চিম দিকের প্রাচীরটিই মোঘল আমলের। প্রধান মেহরাব পশ্চিম প্রাচীরের মাঝ বরাবর। প্রধান মেহরাবের দুই দিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট নকশা করা প্যানেল রয়েছে। এছাড়া দুই পাশে ছোট আকারের দুইটি মেহরাব রয়েছে। মেহরাবগুলো দেয়ালের আয়তাকার ফ্রেমের ভেতরে অবস্থিত।
৭. মোঘলদের বাংলা দখলের ইতিহাস মসৃণ নয়। সম্রাট হুমায়ুন বা আকবরের সময় বাংলা মোঘল সাম্রাজ্যের নিরবিচ্ছিন্ন অধিকারে ছিল না। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে ১৫৯৪ সালে বাংলার মূল নিয়ন্ত্রণ আসে। মোঘলরা শুধু আমাদের শাসন করেছেন কি? মোঘলদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্প, সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন ঘটেছে। সময়ের সাথে সাথে মোঘলদের প্রচেষ্টার ফলে এসেছে মুঘল রন্ধনরীতি এবং মোঘল রন্ধনরীতি থেকে মোঘলাই খাবার। মোঘলাই পরেটা, বিরিয়ানি, ডাল-গোস্ত (হালিম), সামুচা, কোরমা, রেজালা, ফালুদা, জিলাপি এসব মোঘলদের আমল থেকেই বাংলায় প্রচলন শুরু হয়।
৮. মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমি মোঘল আমলের ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছি। প্রথমবার ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করতে পেরে ভালো লাগছে। এই ঈদগাহে একসময় সুবাদার-জায়গীরদার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ঈদের নামাজ আদায় করতেন। এরপর আমার মতো সাধারণ নাগরিকদের জন্য ঈদগাহ নামাজের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের আগে ও পরে মোঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিষয় বারবার আমার স্মৃতিতে আঘাত হানছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পরওয়ানা নিয়ে এলো হাজির হল কেউ! ঢাকার ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ ময়দান থেকে ঈদ শুভেচ্ছা।
লেখক : ব্যাংকার ও গল্পকার।