ভাষা আন্দোলনের সামাজিক গুরুত্ব যেখানে
সব মানুষের কাছে তার মাতৃভাষা সর্বাধিক প্রিয়। কারণ, এ ভাষাতেই মানুষ তার চেতনাকে লালন করে। আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনায় হৃদয়ের গভীরে জাগ্রত ভাব-অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে। এই মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতি আন্দোলন করেছে এবং জীবন বিসর্জন পর্যন্ত দিয়েছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তবে মুখের ভাষার জন্য আন্দোলনের ইতিহাসে বাঙালি একক নয়, আরও দৃষ্টান্ত আছে আগে–পরে।
জানা যায় দ্বাদশ শতকে ইংল্যান্ডের ইংরেজিভাষী মানুষকে লাতিনের পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় ভাবতে, বলতে ও লিখতে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় বিগত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। তবে ব্যাপকতায় ও গণমানুষের সম্পৃক্ততায় বাঙালির ভাষা আন্দোলন ছিল বৃহৎ পরিসরের। এ আন্দোলন বাঙালির আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। ভাষা আন্দোলনের বৈপ্লবিক চেতনার স্পর্শে বাঙালির সামাজিক জীবন যে অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, তা একাত্তরের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও বহমান। সংগত কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাঙালির সামাজিক জীবনে ভাষা আন্দোলনের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ কথা সত্য যে ভাষা আন্দোলনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য থাকলেও এর সামাজিক তাৎপর্যের দিকটি অনেকখানি উপেক্ষিত।
আসলে ভাষা একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। বাঙালি জীবন ও বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা রেনেসাঁর মতোই তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী। বায়ান্নর যে ভাষা আন্দোলন, তা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রয়াস এবং সে সময়কার রাজনৈতিক নেতাদের হঠকারিতা থেকে মুক্তির জন্য অঙ্গুলি নির্দেশ করা। সামাজিক বঞ্চনা-বৈষম্য এ সময়ে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের মনে গভীরভাবে গ্রোথিত হতে থাকে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে তার চরম বিকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের সামাজিক গুরুত্ব¡নিচে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হলো—
১.
ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের রাজনীতিতে কেবল সুদূরপ্রসারী প্রভাবই ফেলেনি, এর সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্নও জড়িয়ে পড়ে। যেমন কেন্দ্রীয় গণপরিষদে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা, আনুপাতিক আসনসংখ্যা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি, কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে বাঙালিদের অধিকসংখ্যক নিয়োগ এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানোর দাবি জানানো হয়। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার জনগণ সর্বপ্রথম তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার জনগণ যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে আলাদা এবং তাদের দাবি যে স্বতন্ত্র খাতে প্রবাহিত হতে পারে, এই শিক্ষা মূলত ভাষা আন্দোলন থেকে আহরিত হয়।
২.
আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন মাত্র। কালক্রমে তা একটি আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আন্দোলনে রূপ নেয়। এ সময়ে অনেক সমাজসচেতন ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক দল এ আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের চিন্তাচেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে ভাষা আন্দোলনের এই প্রেরণা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ফলে ভাষা আন্দোলন একধরনের প্রাদেশিকতাবাদের জন্ম দেয়। এরপর যখনই পূর্ব বাংলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো দাবি উচ্চারিত হয়েছে, তখনই তা পূর্ব বাংলাবাসীর সমর্থন অর্জন করেছে।
৩.
ভাষা আন্দোলন এ দেশের ছাত্রসমাজকে প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার ছাত্ররা প্রথম প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তমদ্দুন মজলিশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই ছাত্রসমাজ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, ন্যায়-অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উচ্চারণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেও ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪.
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতা, শিক্ষক–বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, কৃষক–শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়ান। ফলে তাঁদের মধ্যে ঐক্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সৃষ্টি হয় এবং এ আন্দোলনের ফলে পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
৫.
ভাষা আন্দোলনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এর সঙ্গে জড়িত নেতারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবর্তক। পার্লামেন্টের মধ্যে কংগ্রেসদলীয় হিন্দু নেতারা ভাষার দাবিতে কথা বলেন, আর রাজপথে অকংগ্রেসীয়রা ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। ফলে সে সময়ে পূর্ব বাংলায় নিঃসন্দেহে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
৬.
ভাষা আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি যাবতীয় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং ধর্মীয় অনুশাসন থাকা সত্ত্বেও এ দেশের সচেতন, শিক্ষিত নারীসমাজ এগিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও এ আন্দোলনে অংশ নেয়। ফলে ছাত্রীরা ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর সুযোগ লাভ করে। পরবর্তী সময়ে সভা-সমিতি, কনফারেন্স, সেমিনারে নারীর অংশগ্রহণের এক নতুন ধারা সৃষ্টি হয়।
৭.
ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাবশালী ভূমিকার সূচনা করে। অতীতে এ অঞ্চলে উচ্চ শ্রেণির মাধ্যমেই সব রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হতে দেখা যায়। ভাষা আন্দোলনই প্রথম পূর্ব বাংলায় মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করে, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়।
৮.
প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শহীদ দিবস এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, যা তাদের একই সঙ্গে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
৯.
বাঙালির একান্ত ভাষাশহীদ দিবসটি ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর তাৎপর্য আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা ঠিক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন এ দিবসটি পালিত হয় তখন তারা তাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশ ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কেও কোনো না কোনোভাবে সচেতন হয়। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়। তা ছাড়া দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে একধরনের উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়, যা তাদের মধ্যে সামাজিক সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০.
একুশের মাসে আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ও ইতিহাসের যে তাগিদ আমরা অনুভব করি, তা জাতির প্রেরণার বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে।
১১.
ভাষা আন্দোলন আমাদের সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিশাল ভূমিকা রেখেছে প্রধানত এ জন্য যে আমাদের মনের উপনিবেশমুক্তির পথ নির্দেশ করেছে এই ভাষা আন্দোলন।
১২.
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই এ দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন হয়, যা একটি জাতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মূলমন্ত্র। বাঙালি জাতি নিজের ভাষার মর্যাদার জন্য যুদ্ধ করেছে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এভাবেই শহীদদের রক্তের ওপর গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে উন্মেষ ঘটেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের, শুরু হয়েছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা এবং স্থান নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর