অনুগল্প—রঙিন টেলিভিশন
অনেক দিন আগের কথা, ১৯৮৩ বা ১৯৮৪ সাল হবে, আমার মেজ মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে বেড়াতে এসেছে। অনেক দিন পরে এল, পাঁচ বছর হবে। এটা–সেটা কত কী যে নিয়ে এসেছে আমাদের সবার জন্য। উপহার দেখে আমার রীতিমতো লজ্জা লাগছে।
আমার মেজ মেয়ে আর জামাতা যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক।
রাতে খাবারের পর আমার ঘরে বসে যুক্তরাষ্ট্রের গল্প করতে করতে মেজ মেয়ে বলল, ‘আম্মা, আমি আল্লাহ দিলে ওখানে ভালো করছি আমার পেশায়। মাশা আল্লাহ ভালো টাকাও কামাচ্ছি। সবই তোমার দোয়া, শুধু মনটা খারাপ হয়, আব্বা দেখে যেতে পারল না।
‘আচ্ছা আম্মা, আমি তোমাকে আরও কিছু একটা কিনে দিতে চাই। বলো, তোমার কী লাগবে, তোমার কিসের শখ? সোনার চেইন, না হাতের চুড়ি, কী চাও, বলো। তোমার জন্য আমার একটা বাজেট আছে। বলো, তোমার কী চাই। আমি কিনে দেব।’
আমি বললাম, আমার কিছুই লাগবে না। অনেক কিছু নিয়ে এসেছিস, মা। এগুলোও না আনলেই হতো। জামাই কী ভাববে? কী লজ্জা! আমার সব আছে।
মেয়ে বলল, ‘আমি দেবই, তুমি কী চাও বলো তো, মা।’
আমাদের কথার ভেতর ছোট মেয়ে লতা বলে ফেলল, ‘বুবু, তোর অনেক টাকা, তাহলে আমাদের একটা রঙিন টেলিভিশন কিনে দে। আমাদের তো রঙিন টেলিভিশন নাই। আম্মা দেখবে, আমরাও দেখব।’
মেজ মেয়ে হঠাৎ করে রেগে গেল। বলল, ‘শখ কত! জানিস, রঙিন টেলিভিশনের দাম কত? আর আমি কত কষ্ট করে টাকা কামাই। তোদের মতো দেশে বসে বসে খাই না। আগে লায়েক হও, তারপর নিজের টাকায় রঙিন টেলিভিশন কিনে বাইসকোপ দেখো।’
আমি বললাম, তোরা থাম তো, আমার কিছু লাগবে না।
আমার মেজ মেয়ে উঠে ঘরে চলে গেল।
আমি ছোট মেয়েকে একটা থাপ্পড় মেরে বললাম, তোকে কি আমি বলেছি, আমার রঙিন টেলিভিশন লাগবে, ওকে বলতে? নিজেকে আর মাকে ছোট করে শান্তি হলো?
তারপর মেয়েটার কান্না দেখি আর থামেই না।
ওরা এসেছে বলে ছোট মেয়েটা এ কদিন আমার সঙ্গে ঘুমাবে।
এমনিতেও লতা বেশির ভাগ দিন মাঝরাতে ওর ঘর থেকে এসে আমার কাছে ঘুমায়। ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর আমার বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে আমরা এই দুটো প্রাণী আমাদের সংসারে।
সারা রাত মেয়েটা ঘুমাল না। আমি পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে রাখলাম।
আমার মনে হলো, লতা ওদের নিজের বোন না বলে আমার মেজ মেয়ে এইভাবে কথাটা বলতে পারল।
হ্যাঁ, আমার ছোট মেয়ে লতা আমার পেটের সন্তান নয়। ও আমার স্বামীর কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়, রংপুরে একদিন আমার স্বামী জিপে করে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা শিশুর কান্না শুনতে পান। গাড়ি থামিয়ে খুঁজতে থাকেন। তারপর বুঝতে পারেন, রাস্তার ম্যানহোলের ভেতর থেকে আসছে শব্দটা। চালককে নিয়ে ম্যানহোলের ভেতর থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেন।
শিশুটিকে ইট দিয়ে বেঁধে ম্যানহোলে ফেলে দিয়েছে কারা জানি, যেন মারা যায়। ওর বয়স তখন দুই বছরের কম। আমার স্বামী ওকে আমার কাছে এনে বলেছিলেন, ‘জানি না কার সন্তান। কারাই বা এই যুদ্ধের সময় এভাবে ফেলে দিয়ে গেছে। হয়তো ওর মা–বাবাসহ সবাইকে মেরে ফেলেছে। আজ থেকে ও আমাদের মেয়ে। আল্লাহ আমার কাছে দিয়েছে, ও আমাদেরই মেয়ে। ওর নাম রাখলাম লতা।’
ধীরে ধীরে অনেক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখি দিতে লাগল লতার। কিন্তু আমরা ওকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছি।
১৯৭৬ সালে ওদের বাবার হঠাৎ একদিন শরীরটা খারাপ করল। আমরা ডাক্তার ডাকলাম। ওদের বাবা আমাদের বললেন, ‘তোমরা আমাকে কথা দাও, আমার কিছু হলেও তোমরা লতাকে ফেলে দেবে না।’
আমি আর মেয়েরা কাঁদছি, এগুলো কী বলেন উনি! তিনি বললেন, ‘ওকে ফেলে দিলে আমি মরে গেলেও ভালো থাকব না, শান্তি পাব না।’
তারপর হঠাৎ আর কোনো শব্দ নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ।
আজকের ঘটনায় আমার মনে হলো, আমার মেজ মেয়ে কী করে ভুলে গেল ওর বাবার শেষ কথাগুলো! সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না, নিজের কাছের মানুষের কাছ থেকে অপমান তো মানতে পারছিলাম না।
হতে পারে আমাদের ঘরে সাদাকালো টেলিভিশন, রঙিন টেলিভিশন নেই। কিন্তু ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি এতটা বছর কী করে চলেছি, ওরা জানে না। লতা ওদের মতো পড়ালেখা করে লায়েক হতে পারেনি, এখনও মানসিকভাবে শিশুর মতো, কিন্তু আমাকে ছাড়া ওর আর কী আছে!
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সারা রাত আমি ঘুমাতে পারলাম না। মা–মেয়েতে বালিশ ভেজালাম চোখের জলে, কেউ কাউকে কিছু বললাম না।
সকালে উঠে আমার বান্ধবী পারভিনকে ফোন করলাম। বললাম, তোদের গাড়িটা নিয়ে একটু আয়। আমার বায়তুল মোকাররমে একটু কাজ আছে। অবশ্যই আসবি কিন্তু।
পারভিন এল। আমার দাদির একটা সোনার বাজুবান ছিল, ওটা আমার গহনার বাক্স থেকে নিলাম। হাতে রঙিন টেলিভিশন কেনার মতো টাকা আমার ছিল না তখন। ঠিক করলাম, ওটা বিক্রি করে আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমি রঙিন টেলিভিশন কিনব।
পারভিন বলল, ‘ওটা বেচতে হবে না, আমি দিচ্ছি।’ আমি বললাম, না। ঋণ করে কিনব না।
যা–ই হোক, সন্ধ্যার মধ্যে রঙিন টেলিভিশন এল।
ড্রয়িং রুমের সাদাকালো টেলিভিশনটা আমি সরালাম না। ওটা ওদের বাবার কিনা, তিনি যেভাবে সাজিয়েছিলেন, আমি ওটা ওভাবেই ড্রয়িং রুমে দেখতে চাই।
রঙিন টেলিভিশনের জায়গা হলো আমার ঘরে। আমার মেয়েরা জানতে চাইল, টাকা কোথায় পেলাম, রঙিন টেলিভিশন এল কেমন করে?
আমি কিছু বললাম না। ওরাও বুঝতে পারল বোধ হয়। আমারই তো মেয়ে, না বোঝার কথা নয়। কিন্তু আমার লতার সে কী খুশি! মনে হলো, আমার মেয়ের খুশির চেয়ে আর বড় কী আছে!
মেজ মেয়ে সেবার যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যাওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, আমার ভুল হয়ে গেছে, তুমি মনে কোনো কষ্ট রেখো না।’ বললাম, আমার কোনো কষ্ট নেই, মা। তোরা ভালো থাকলেই মা ভালো থাকে।
মিথ্যা বলেছিলাম। আবার আল্লাহর কাছে মাফও চেয়েছিলাম, যেন আমার কষ্টে আমার সন্তানদের কোনো কষ্ট না হয়। বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি একবার বের হয়ে গেলে তা তো আর ফেরত নেওয়া যায় না।
তারপর এতটা বছরে কত নতুন টেলিভিশন ঘরে এল আর গেল, কিন্তু ওই প্রথম রঙিন টেলিভিশন কেনার কথা আমার আজও মনে পড়ে।