সফুরা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

হারেজ শেখের একমাত্র মেয়ে সফুরা। বয়স একুশ কি বাইশ হবে। যেমন সাহসী তেমন ডানপিটে। সব সময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখছে, অন্যায়-অবিচার বলতে যা বোঝায়, সেসবের অধিকাংশই তার বাবা-চাচারা করে। এ জন্য সে তাদের শাসনের ধার ধারে না।

সফুরা শেখ গোষ্ঠীর মেয়ে। এলাকায় এ গোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে যেমন সচ্ছল, তেমনি মারামারিতে সবচেয়ে এগিয়ে। তাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার কেউ দশ গ্রামে নেই। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুরে মাছ এবং পঁচিশ থেকে তিরিশ জন কাজের লোক সারা বছর এখানে কাজ করে। এ ছাড়া ডজনখানেক লাঠিয়াল সব সময় বাড়িতে সতর্ক অবস্থায় থাকে।

টাকাকড়ি, সহায়সম্পত্তি থাকলেও তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেই। ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নেই। সবচেয়ে কষ্টে থাকে তাদের সংসারের মেয়েরা। এ গোষ্ঠীতে জন্ম নেওয়া মেয়েরা প্রার্থনা করে, কবে তাদের বিয়ে হবে, এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা মেয়েরা!

অর্থকড়ি থাকার কারণে শেখেরা দূরদূরান্তে গিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার দুর্বলতার সুযোগে সহজ-সরল মেয়েদের বউ করে নিয়ে আসে। তারপর তাদের দাসী হিসেবে কাজে লাগায়। অনাহারে, অপুষ্টিতে আর শারীরিক নির্যাতনে তারা নির্জীব প্রাণীর মতো বেঁচে থাকে। অনেকে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়, কেউ কেউ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এতে অবশ্য কারোর কিছু আসে যায় না। একটা বউ মরলে আরেকটা নিয়ে আসে। স্ত্রীলোকের চেয়ে হালের গরুর দাম তাদের কাছে অনেক বেশি!

এ রকম পারিবারিক কাঠামোতে বেড়ে উঠেছে সফুরা। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড জেদি আর আপসহীন। বাপ-চাচা কিংবা ভাইদের গুরুত্ব দেয় না। সব সময় তাদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা চলে। সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, যার পরিণামে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাকে।

আস্তে আস্তে সফুরা বড় হতে থাকে। কিশোরী থেকে যৌবনে পা দিলেও প্রতিবাদী সত্তার কোনো পরিবর্তন হয় না। নিজের বাপ-ভাই-চাচাদের বিরুদ্ধে একক অসম প্রতিবাদ। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও একা এক বিশাল হিংস্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে চলে মেয়েটা।

পাশের বাড়ির তুরাব মণ্ডলকে ভালো লাগে সফুরার। সাদাসিধা সহজ-সরল হিসেবে তুরাব মণ্ডল বেশ পরিচিত। তা ছাড়া সে ঝগড়া-বিবাদ করে না, এমনকি কারোর আগে-পিছে থাকে না। নিজের অজান্তেই সঙ্গী হিসেবে তুরাব মণ্ডলকে বেছে নেয় সফুরা। আড়ালে-আবডালে চুপিসারে দুজনের এক-আধটু কথা, অতঃপর মন দেওয়া-নেওয়া।

কিন্তু শেখদের সঙ্গে মণ্ডলদের দা-কুমড়া সম্পর্ক। শেখদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক-আধটু তারাই প্রতিবাদ করে। খুনোখুনিও হয়েছে তাদের মধ্যে। এমনকি সফুরার দাদা মণ্ডলদের ফাঁসানোর জন্য নিজের ছেলেকে পর্যন্ত খুন করেছে। সফুরা এসবের ধার ধারে না। সে রাতে লুকিয়ে তুরাবের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

হারেজ শেখ বুঝতে পারে, মেয়ে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একদিন বিকেলে সফুরা দেখে শেখ বাড়িতে অনেক লোক। এর কিছু সময় পর জানতে পারে তার বিয়ে! সেদিন পাবনার চাটমোহরের মাজেদের সঙ্গে জোর করে সফুরার বিয়ে দেওয়া হয়। তুরাব মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় সে পায় না।

মাজেদ বাজারে সবজির ব্যবসা করে। অবস্থাও বেশ ভালো। কিন্তু আজন্ম বিদ্রোহী সফুরাকে বোঝানোর ক্ষমতা তার নেই। একটা মুহূর্তের জন্য তাদের মধ্যে বনিবনা হয় না। শারীরিক গঠন অনেক ভালো বলে মাজেদ মাঝেমধ্যেই সফুরার আক্রমণের শিকার হয়।

এক রাতে মাজেদের সঙ্গে মারামারি করে ভোরের ট্রেনে সফুরা নিজ বাড়িতে চলে আসে। এরপরে সফুরা আর কোনো দিন শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হারেজ শেখ মেয়েকে নৃশংসভাবে পিটিয়েছে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর জন্য, কিন্তু লাভ হয়নি। বাড়িতে এসেই সে তুরাব মণ্ডলের সঙ্গে নতুনভাবে যোগাযোগ শুরু করে। তখন আর এটা গোপন থাকে না।

কিছুদিন পর সফুরা বুঝতে পারে তার শরীরের মধ্যে নতুন প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে। এর পর থেকেই গ্রামের মানুষ কানাকানি শুরু করে, সফুরার পেটের সন্তানের বাবা আসলে কে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে আরেকটা শরীর বৃদ্ধি পেতে থাকে আর বাইরে বাবা-ভাইয়ের অসহ্য নির্যাতন সমান্তরালে চলতে থাকে। এই অসময়ে সাহস এবং সহ্যের ক্ষমতা কমে আসে সফুরার। এখন দুজনকে নিয়ে চিন্তা করতে হয়। তবু সে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, মরে গেলেও বাপ-চাচার অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করবে না!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সব অত্যাচার সহ্য করে ফুটফুটে এক ছেলেসন্তানের জন্ম দেয় সফুরা। ছেলের জন্মের কথা শুনে আজান দেয় তুরাব মণ্ডল, নাম রাখে বক্কর। গ্রামের মানুষের বুঝতে বাকি থাকে না, এ সন্তানের বাবা তুরাব মণ্ডল। বিয়ে না করেই সন্তান, সবাই ছি ছি করে। সফুরা বলে সে অন্যায় কিছু করেনি, কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করে না। কেউ সত্যটা জানতে চায় না!

সফুরার চাচারা, চাচাতো ভাইয়েরা বলে, এমন চরিত্রহীন মেয়ের জন্য শেখবাড়ির মানসম্মান আর অবশিষ্ট নেই, সব ধুলোয় মিশে গেছে। এসব সহ্য হয় না হারেজ শেখের। সে পাগলা কুকুরের মতো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এ রকম মেয়েকে আগেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল। দেরি হয়ে গেছে। তাই সে এখন আর সময় নষ্ট করতে চায় না। তিন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সফুরাকে সন্তানসহ পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে। কাজটা তারা এ সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করতে চায়। এখন চৈত্র মাস। হরহামেশাই চারদিকে অগ্নিকাণ্ডের খবর শোনা যায়। এ রকম আগুনে যে-কেউ মারা যেতে পারে। ব্যাপারটা বেশ বিশ্বাসযোগ্য হবে, কাকপক্ষীও টের পাবে না। যদি তুরাব মণ্ডল বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তার পরিণামও একই হবে!

বক্করের জন্মের পর সফুরা আলাদা ঘরে থাকে। টিনশেড ঘরের তিনদিকে টিনের বেড়া আরেক পাশে পাটখড়ির। আগে এখানে কাজের লোকেরা থাকত। এই ঘর অন্য সব ঘর থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

পরের দিন শ্রমিকেরা ঘরের চারদিকে শুকনা খড় স্তূপ করে রাখে। ঘরের মধ্যেও কিছু খড় রেখে দেয়। তারা বলে আকাশের অবস্থা ভালো নয়, যেকোনো সময় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে, সে জন্য কিছু খড় ঘরের মধ্যে রাখতে হচ্ছে।

সফুরা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, কিছু একটা আঁচ করতে পারে। তাই হাতের কাছে একটা বঁটি রেখে বক্করকে নিয়ে ঘুমাতে যায়। রাতে দুই ভাই সাবধানে পাহারা দেয়, কখন সফুরা ঘুমায়। কিছু সময় পর কুপি নিভিয়ে সফুরা ঘুমিয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পরে খড়ের স্তূপে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সফুরা তখনো বক্করকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। খড় পোড়ার সময় চটচট একটা শব্দ হয়। সে শব্দে সফুরার ঘুম ভেঙে যায়। সে দ্রুত একপাশের বেড়া বঁটি দিয়ে কেটে বক্করকে নিয়ে বের হয়ে আসে।

সফুরা বাইরে এসে দেখে বাপ-ভাইয়েরা কানাকানি করছে। হারেজ শেখের কল্পনাতেও ছিল না, তার মেয়ে এভাবে অগ্নিকুণ্ডলী থেকে বের হয়ে আসবে। রাগে তার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। এ রকম একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা হালে পানি পেল না! ইতিমধ্যে চারদিক থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে চেঁচামেচি শুরু হয়। লোকজন এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে।

সফুরা কান্নারত বক্করকে নিয়ে তার মায়ের কাছে যায়। সে জানে, মা রহিমুন্নেসা নির্যাতন সহ্য করতে করতে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। তবু মায়ের আঁচলের নিচে আশ্রয় খোঁজে। মায়ের কোলে বক্করকে দিয়ে সে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। রহিমুন্নেসা মেয়ের কাপড়ে লাগা আগুন পানি দিয়ে নিভিয়ে দেয়। সফুরার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। চিত্কার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হয় না। তাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে, তার জন্মদাতা তাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করতে চাচ্ছে। যে ছোট ভাইকে কোলে কোলে বড় করেছে, আজ সেই ছোট ভাই তাকে খুন করতে না পেরে আফসোস করছে। সফুরা হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের কাছে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে! তার এ আর্তনাদ হারেজ শেখের কানে পৌঁছায় না!

নিজের মেয়ের উপস্থিত বুদ্ধির কাছে ধরাশায়ী হয়ে রাগে গজগজ করতে থাকে হারেজ শেখ। সামনে তিন ছেলে মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট ছেলে বিড়বিড় করে বলে, আজ কিংবা কাল মরতে তোকে হবেই!

পরের দিন বাপ-বেটা মিলে হত্যার নতুন পরিকল্পনা করে।

*লেখক: রূপক রেজা, মিরপুর, ঢাকা।