চট্টগ্রাম বইমেলা: বইমেলায় যেসব অনুষঙ্গ থাকা প্রয়োজন

অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-কে ঘিরে চট্টগ্রামের সিআরবির শিরীষতলাকে সাজানো হয়েছে। ছবিটি ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তোলা হয়েছেছবি: সাফিনাতুন জাহান সাবরিন

বাংলাদেশের বইমেলা জনসাধারণের জন্য অনেক জনপ্রিয় একটি স্থান। যদিও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো বইমেলার তেমন আয়োজন দেখা যায় না আর বইয়ের সুঘ্রাণও তাই ততটা সমাদৃত হয়নি। বিভাগ, জেলা ও উপজেলাকেন্দ্রিক বর্তমানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশেষ করে বাঙালির ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই মাসজুড়ে দেশে বইমেলা বসে। মানুষের দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার জায়গা হলো বইমেলা।

ঢাকা একুশে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল বইমেলার সৌন্দর্য মেধা-মননদীপ্ত মানুষের আনাগোনা দেখে সত্যি মন ভরে যায়। বইমেলায় প্রতিদিন লেখকদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয়। সঙ্গে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গানের আসর। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই সময় কাটে বইমেলায় গেলে। কিন্তু বইমেলায় গেলে অনেক অনুষঙ্গ কম দেখতে পাই, যা থাকলে হয়তো বইমেলা এবং বইয়ের সঙ্গে পরম আত্মীয়ের মেলায় পরিণত হতো।

টমাস আলভা এডিসন বলেছেন, ‘জ্ঞানের প্রথম ধাপ হচ্ছে আমরা যে মূর্খ, তা জানা।’ কথাটি গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা শৈশবে যখন কথা বলতে শিখি, তখনই তা প্রথম উপলব্ধি হয়। মূর্খ বলেই বারবার চেষ্টা করা লাগে জ্ঞানে-গরিমায় নিজেকে আয়ত্তে আনতে ও সমৃদ্ধ করতে।

এবার চট্টগ্রাম বইমেলায় গিয়ে আমার মন কেড়েছে বিদ্যানন্দ বই স্টলটি। নারী-পুরুষ পাঠকের জন্য আলাদা বসে পড়ার ব্যবস্থা রেখেছে তারা, যা আমার কাছে ইউনিক আইডিয়া মনে হয়েছে। তবে ঢাকার বইমেলায় এদের স্টল নিয়ে নানা ধরনের কথা, সমালোচনা ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

একজন পাঠক যখন বই নাড়াচাড়া করেন, তখন তাঁর উৎসুক মন তা পড়তে চায়, কিন্তু সেই দীর্ঘ সুযোগ, পড়ে বই কেনার সুযোগ বইমেলায় থাকে না। এরপর প্রচণ্ড ভিড়ে বই মনমতো কেনাও বেশ কঠিন বিষয়। অনেকেই লেখক নাম দেখে বই কেনেন। আবার অনেকেই খুঁটে খুঁটে বই দেখে পড়ে বই কেনেন। এসব সমঝদার পাঠকের জন্য যদি বসে পড়ার মতো বড়সড় ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে বই বেচাকেনা আরও বাড়ত বলে মনে করেন বিজ্ঞজনেরা। বইমেলা হোক একটা লাইব্রেরির মতো। যেখানেই যে স্টলে যাবে, পাঠক একটু সময় নিয়ে বইটি পড়ে যাচাই-বাছাই করতে পারে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত।

এবার চট্টগ্রাম বইমেলায় শিশুদের জন্য মিনি পার্কের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। শিশুরা একটু রিল্যাক্স চায় সব সময়। বইয়ের মর্ম ওরা কতটুকুই-বা বুঝে। পাঠকেরা শিশুদের ওই দিকে ব্যস্ত রেখে নিজেদের পছন্দমতো বই কিনতে সহজ হয় আর শিশুরাও বেশ আনন্দ পায়।

বইমেলার সবচেয়ে বড় কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা হলো টয়লেট ও ওয়াশব্লকের চরম অব্যবস্থাপনা। এটি আরও বহুগুণে উন্নতমানের করা উচিত। বইমেলা বছরে বছরে স্থান পরিবর্তন না করে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় হলে তবে স্থায়ীভাবে পাবলিক টয়লেট ও ওয়াশব্লক নির্মাণ করা যেতে পারে।

বইমেলায় সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা হয়ে থাকেন নতুন লেখকেরা। তাঁদের সঙ্গে নবীন-প্রবীণ লেখকদের পরিচয়পর্ব ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ সেশন চালু করা বইমেলা চলাকালে খুবই প্রয়োজন। কারণ, বইমেলা হলো সব সৃষ্টিশীল লেখকের মিলনস্থল। তাই সহজেই সেই প্রশিক্ষণের কাজটি অনায়াসে বইমেলায় ব্যবস্থা করা যায়। সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।

দেশে ভালো সৃজনশীল লেখকসমাজ গড়ে তুলতে হলে তাঁদের বিচ্ছিন্ন না রেখে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবতে হবে। একজন লেখক, দার্শনিক কিন্তু তাঁর মেধা-মনন কথা, লেখা দিয়ে একটি দেশের আমূল পরিবর্তন করতে পারে। এ রকম পৃথিবীতে হাজারো উদাহরণ আছে। লেখকেরা দৈবশক্তিসম্পন্ন মানুষ। স্রষ্টার থেকে লেখালেখির ঐশ্বরিক বর নিয়েই তাঁরা পৃথিবীতে আগমন করেন। তাই লেখক কিংবা কবিদের আর অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই।

নতুন লেখকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়াও কিন্তু সরকারের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত। কারণ, নতুনেরা যতই সৃষ্টিশীল কাজে এগিয়ে আসবেন, ততই দেশে শান্তি বিরাজ করবে। অন্যায়-জুলুম করার মানসিকতা আর তাঁদের থাকবে না যখন জ্ঞানের পথে চলতে শিখবে। এ ক্ষেত্রে মেলায় ঘুরে ঘুরে সরকারি প্রতিনিধি দ্বারা নতুন লেখকদের বই কেনা উচিত। যেমন একজন কৃষক থেকে সরকার ধান কেনে তেমন। কৃষক খাবার উৎপাদন করে আর লেখক জ্ঞানের সাগর রচনা করেন তাঁর বইয়ে। নতুন লেখকদের প্রবীণ লেখকদের মতো বিভিন্ন সম্মাননা দেওয়া রচিত। যাতে তাঁরা উৎসাহিত হন। এসব কার্যক্রম চালু না করলে আমার মনে হয় কিছু বই বেচাকেনা-সর্বস্ব বইমেলা হচ্ছে প্রতিবছর।

সারা বছর প্রচণ্ড খেটেখুটে প্রকাশকেরা বই প্রকাশ করেন। তাঁদের শ্রম ও অর্থ প্রচুর যায় বইবাজারে। কিন্তু তাঁদের সম্মানটুকু দিতে আমাদের যেন চরম কার্পণ্য কাজ করে। বইয়ের ওপর বইয়ের পসরা প্রকাশদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সাজানো হয় স্টলগুলোতে। প্রয়োজনে সরকারকে প্রকাশকের পাশে দাঁড়াতে হবে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দিয়ে। বিশেষ করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত লেখক-প্রকাশক সবাইকে। এতে অল্প খরচে লেখক সরকারি সহায়তায় ভালো ভালো বই লিখবেন ও প্রকাশক মনমতো পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করে আনন্দ ও তৃপ্তি পাবেন।

পাশাপাশি বই বেচাকেনা ভালো হলে কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লেখকও একটা সম্মানজনক সম্মানী পাওয়ার রেওয়াজ চালু হওয়া উচিত। না হয় এত কষ্টকর দীর্ঘ এক মাসের বইমেলার আয়োজন ব্যর্থ হবে।

লেখকেরা কি বই লিখবেন নাকি বই ফেরি করবেন? একজন সৃষ্টিশীল লোককে দিয়ে কি দুটো কাজ একসঙ্গে করানো উচিত? বই বিক্রির চিন্তা থাকলে লেখক তাহলে মাথা খাটিয়ে বই লিখবেন কখন? তাই বইমেলায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করানো উচিত, যাতে তারা মূল্যছাড়ে লেখকদের বই সরাসরি পেতে পারেন।

এবার চট্টগ্রাম বইমেলায় সন্ধ্যায় গিয়ে দেখলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। দারুণ সব কোকিলকণ্ঠী গায়ক-গায়িকা গান করছেন, আবৃত্তি করছেন, কবিরা আর নৃত্যশিল্পীরা সুরে-ছন্দ তালে গানে-নেচে মাতোয়ারা করছেন উপস্থিত দর্শক ও পাঠকদের। এত সুন্দর আয়োজনে মন ভালো না হয়ে যাবে কোথায়? কিন্তু দীর্ঘক্ষণ গান শোনা বা বসলে মাথা দেখি ব্যথায় টনটন করছে। এতটাই শব্দদূষণের কবলে পড়েছে বইমেলাগুলো। এসব যেন কেউ দেখার নেই। মানুষের বই পড়ার মুডটাই নষ্ট হয়ে যায় এত শব্দদূষণে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ বইমেলায় দর্শনার্থী কিংবা পাঠকের জন্য শান্তিময় রাখার চেষ্টা করবেন। বইমেলা মানেই জ্ঞানের মেলা কোনো চিৎকার-চেঁচামেচির মেলা নয় মোটেও। তাই এখানে সহনীয় পর্যায়ে সাউন্ড থাকা উচিত।

বইমেলায় বই  বিক্রির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব গাছ উপহার দেওয়া উচিত প্রকাশকদের। এতে বইয়ের মতো গাছটিও দেশে ফুল, ফল ও নির্মল অক্সিজেনের আশ্রয় হবে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরসবুজ হবে আমাদের দেশটি। ভাবতেই কত ভালো লাগছে তাই না? মানুষ চেষ্টা করলে এসব ভালো কাজ সহজেই করতে পারে। কেবল একটু সদিচ্ছার দরকার। আর দরকার সঠিক পরিকল্পনা।

আমাদের চট্টগ্রামের বইমেলা বসেছে সিআরবি শিরীষতলা। অনিন্দ্যসুন্দর এ জায়গাটিতে বইমেলার উপযুক্ত জায়গা মনে করেন সুধীজনেরা। এখানে প্রচুর বসার জায়গা আছে, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আছে দেখলাম। পাশাপাশি মাটির বাসনকোসনও বিক্রি হচ্ছে। এককথায় দারুণ উপভোগ্য হচ্ছে আমাদের চট্টগ্রামের বইমেলা। কিন্তু এতেও বেশ কিছু অসংগতি লক্ষ করা যায়, যা খুবই বিরক্তির কারণ হয়েছে পাঠক ও দর্শনার্থীদের কাছে।

লেখকদের বসার জায়গার সুন্দর ব্যবস্থা থাকা দরকার। মিডিয়ায় নতুন-পুরোনো লেখকদের বই নিয়ে আলোচনা বা টক শো হওয়া দরকার, যা নতুন প্রজন্ম বই লেখা ও পড়াতে আগ্রহী হয়। পাঠক সাধারণ বই কিনবে যদি লেখক সমাগম বইমেলায় বাড়ে। পাঠকের মনে লেখকেরা একেকজন অনুপ্রেরণার মানুষ। আসুন, বইমেলায় যায় এবং সাধ্যমতো ভালো বই কিনি। আমাদের সন্তানদের হাতে মোবাইল নয়, একটি ভালো বই তার হাতে তুলে দিই। মোবাইলের আসক্তি কমুক, কোমল হাতের স্পর্শে বর্ণমালা সতেজ মেধাদীপ্ত  প্রাণ ফিরে পাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটাই কামনা করি।

  • লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম।

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]