সিনেমা দেখছি, কিন্তু প্রশ্ন, কোথায়?

ফারুক ও কবরী অভিনীত দর্শকপ্রিয় সিনেমা ‘সুজন সখী’
ছবি: সংগৃহীত

সত্তরের দশকেও এই বাংলাদেশে লেটনাইট শোতে সাধারণ লোকজন সিনেমা দেখতেন। সাধারণ লোকজন বলতে বোঝাচ্ছি সিনেমার সাধারণ দর্শক। আমার মনে হয়, বলতে পারেন সিনেমার প্রকৃত দর্শক। একটা ‘আগুনের পরশমণি’, ‘মনপুরা’ অথবা ‘আয়নাবাজি’র পক্ষে সিনেমার সুদিন ফিরিয়ে আনা কতটুকু সম্ভব ছিল অথবা ঘটেছিল, সেই প্রশ্ন করা বোধকরি অমূলক নয়। একটি বা দুটি সিনেমার পক্ষে সেটা ঘটানো বাস্তবিক অর্থে সম্ভব নয়। সিনেমা তাহলে কী করে? সিনেমা-নাটক-থিয়েটার-গান হলো কোনো সমাজের নিজস্ব প্রতিচ্ছবি। যেই মালয়ালম অথবা কোরিয়ান সিনেমা, কনটেন্টের গুণগান আমরা শুনি, সেটা ওই সব সমাজের উৎকৃষ্টতার প্রতিচ্ছবি বলে আমি মনে করি।

আমাদের সমাজ যতই এগোচ্ছে, রাজনীতি ও জীবনের অন্যান্য আঙ্গিক থেকে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। যার কারণে কোনো সমস্যার সমাধান করা অথবা সমাধান কেমন করে হতে পারে, সেটা সচরাচর আমরা ভাবি না। কারণ, ভাবতে পারি না। ফলে সমস্যার দলবল আরও মহিরুহ হয়ে উঠছে। পারিবারিক পর্যায় থেকে সমাজ, এমনকি বৈশ্বিক পর্যায়ের সমস্যার ক্ষেত্রেও দেখবেন তা-ই ঘটছে। শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রের পক্ষেই দর্শন তৈরি করার সক্ষমতা আছে। একটা ভিন্ন দর্শনের, নতুন দর্শনের অনেক কিছু বদলে ফেলার ক্ষমতা থাকে। এখানেই শিল্পমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

বর্তমান সময়ে অথবা বিগত ২০-২৫ বছরে আমাদের কাছে সিনেমা, নাটক, গান কি ভালো দিন পার করতে পারছে? আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের সমস্যাগুলোও দিন দিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। আমার ধারণা, এর কারণ শুধু আমাদের শিল্পমাধ্যমগুলো দর্শন তৈরি করতে পারছে না তা নয়, এর কারণ শিল্পের দর্শন তৈরি করার ক্ষমতা আরও বহু আগে থেকেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আমরা প্রায়ই কোনো কোনো নির্মাতা বা শিল্পীকে বলতে শুনি, ‘এই সব কাজই গণমানুষের পছন্দ, তাই ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করি না।’ গণমানুষের পছন্দ আগে তৈরি হতো। বহু নির্মাতাই তাতে সফল ছিলেন। বোধকরি নব্বই দশকের গোড়ার সময় পর্যন্তও আমাদের শিল্পমাধ্যম যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। নব্বই দশকের শেষের দিক থেকেই ক্রমে শিল্পের ক্ষমতা নিস্তেজ হওয়া শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে হালের দর্শকদের পছন্দের উন্নয়ন ঘটবে কেমন করে?

‘পরাণ’ এই সময়ের একটি ভীষণ সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র। কাহিনি আবর্তিত হয় একজন মেয়ে এবং তার দুই প্রেমিককে নিয়ে (সমাজ ও দেশের দৃষ্টিতে)। সত্য ঘটনা আশ্রিত সিনেমাতে অথবা ভিন্ন ধারণার আধারে কোনো গান বা লেখা হলে সাধারণত সেই কাজে আমরা নতুন ভাবনার জানালা পাই অথবা প্রকৃত ঘটনার একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাই। সে কারণেই বলা হয়, সত্য ঘটনা নয়, তবে সেটা থেকে অনুপ্রাণিত।

আমাদের সমাজকাঠামোতে নারী যেন সব ঘটনার ‘আসামি’। আমি নারীবাদী নই, আমি প্রকৃতিবাদী। তবে আমি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো দেখতে পাই এবং বলতে পারি। ‘পরাণ’-এর নির্মাতা কি পারতেন না নারীর অবধারিত আসামি স্থানে থেকেই মূল চরিত্রের আরেকটা ভিন্ন মনস্তত্ত্ব দেখাতে? ভিন্ন মনস্তত্ত্ব দেখালে কিছু প্রমাণিত হয় না, তবে সাধারণ দর্শকের ভাবনার আকাশে নতুন জানালা খোলে।

ষাট বা সত্তরের দশকের সাধারণ শিল্পপ্রেমী মানুষের বেশির ভাগই যথেষ্ট পরিমাণ অর্থবহ মস্তিষ্কের অধিকারী ছিলেন। হালে সেই অর্থে শিল্পপ্রেমী মানুষ দূরস্থান, প্রকৃত অর্থে শিল্পী খুঁজে পাওয়া দায়। শিল্পের ন্যূনতম মানবিক গুণাবলি বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাই না। বর্তমান সময়ের সমাজ যেমন এ-জাতীয় বিষয়ে অজ্ঞ, একইভাবে এই সময়ের অধিকাংশ শিল্পী প্রকৃত শিল্পচর্চা পাননি, তাই করেনও না। এমন একটা সময়ের এমন চর্চার ফলে তথাকথিত পৌরুষসর্বস্ব ভাবনানির্ভর ও নারীর প্রতি অসংবেদনশীল চরিত্রকে মূল চরিত্র করে সিনেমা পর্যন্ত তৈরি হয়ে যায়। আর আমরা তা চোখ বন্ধ করে দেখি। পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রাক্তন’ ও ‘বেলা শেষে’ সিনেমাগুলোতে নারী-পুরুষের বিভিন্ন সম্পর্ক তুলে ধরার কারণে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। এ-জাতীয় সমালোচনা আমাদের অন্তত শুরু হওয়া উচিত।

আমাদের দেশে সিনেমা দেখে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ বিনোদিত হয়ে ফিরছেন। কারোর মনে প্রশ্ন জাগছে না? কোনো রকম অসংগতি দেখছেন, কেউ মনে করছেন না? কারোর মনে সামান্যতম প্রশ্ন জাগছে না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এমন সমাজ, এমন সিনেমা আমাদের সিনেমার অগ্রজ প্রাজ্ঞজনদের কেউ চাননি।

*ফারহান আবিদ: লেখক