জীবন থেকে নেয়া: কালজয়ী রাজনৈতিক এক আখ্যান

২৬ মার্চ। বাংলাদেশি মানুষদের জন্য এই তারিখ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। একাত্তর সালের এই দিনেই পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায্য দখল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সে উপলক্ষে আজ একটা বিশেষ চলচ্চিত্রের ওপর আলোকপাত করব। দৌড়ঝাঁপ আর প্রযুক্তির অস্থির সময়ে দেশ বা রাজনীতি নিয়ে ভাবার আমাদের এত সময় কোথায়?

এই যে অস্থির এ সময়ে চিন্তার যে অন্তঃসারশূন্যতা, সিনেমা বা চলচ্চিত্রই বোধ হয় পারে আমাদের মনে উর্বর ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করতে। যে সিনেমা নিয়ে কথা বলছি, ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ প্রিয় সেই সিনেমার শিকড়ে আছে একটা দেশের জন্মের ইতিহাস আর রাজনৈতিক ভাবনা, যা যেকোনো সময়ই প্রাসঙ্গিক। তা ছাড়া ক্রমবর্ধমান অন্ধকার সময়ে এ ধরনের সিনেমা আশা জোগায়।

আইনের খড়্গ

সিনেমাটির নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। জহির রায়হান পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। পূর্ব পাকিস্তান সময়ে মুক্তির পরপর সিনেমাটির ওপর আইনের খড়্গ নেমে আসে। প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হলেও কলকাতায় সিনেমাটি রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসাসফল হয়। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি নেতা রাও ফরমান আলী সেন্সর বোর্ডে এই সিনেমা মুক্তির আগেই আটকে দিতে চেয়েছিলেন। সেন্সর বোর্ডের সদস্য প্রখ্যাত বাংলাদেশি সাহিত্যিক আসকার ইবন শাইখের হস্তক্ষেপে সিনেমাটি মুক্তি পায়।

প্রতীকের নানান ব্যবহার

ঠিক কেন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী চায়নি এই ছবি মুক্তি পাক? কী আছে এ সিনেমায়? সিনেমাটি শুরু হয় কী দিয়ে মনে আছে? আনোয়ার হোসেন প্ল্যাকার্ড বানাচ্ছেন, লেখা ‘অমর একুশে’। সে সময় একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়টাই নিষিদ্ধ ছিল পাকিস্তানিদের কাছে, পাকিস্তানিরা কখনোই চায়নি বাংলা ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক। আর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষা এই প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেই যে সিনেমার শুরুতেই বিপ্লবের গন্ধ, তার সুর ধরে সিনেমাটি এগিয়ে চলে। বিপ্লবী আনোয়ার হোসেনের দুই বোনকে বিয়ে দেওয়া হয় এক কয়েদখানাতুল্য বাড়ির কর্ত্রী রওশন জামিলের দুই ভাইয়ের সঙ্গে। যে কয়েদখানায় দুই ভাই দেয়ালে পোস্টার সাঁটায়, তাদের বোনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে! এই কয়েদখানাকে জহির রায়হান দেখিয়েছেন পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নির্যাতনের প্রতীক হিসেবে।

বাস্তবতাই যখন সিনেমা

বেচারা বাড়ির কর্তা হয়েও খান আতাউর রহমান নির্বাক পুতুল হয়েই থাকেন স্ত্রী রওশন জামিলের অত্যাচারের ভয়ে। তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ। তবু সাহস করে ছাদে উঠে দুই–এক লাইন গান তিনি নিজের মনেই গেয়ে ওঠেন—
‘দিকে দিকে বাজল যখন
শেকল ভাঙার গান,
আমি তখন চোরের মতো
হুজুর হুজুর করায় রত।
এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?’

স্বামীর আপাত অনুগতভাব দেখেও স্ত্রী রওশন জামিল ক্ষান্ত হন না। প্রায়ই তিনি রাগ হলেই স্বামীকে নিশানা করে বাটি–ঘটি, হাতের কাছে যা কিছু পান, সব ছুড়ে ফেলেন। ওই দৃশ্যটা মারাত্মক, যেখানে বাটি থেকে ছিটকে পড়া একটি জ্যান্ত কই মাছ মাটিতে আছড়ে পড়ে ছটফট করতে থাকে। দুই ভাইকেও তিনি তাঁর কবজায়ই রাখার ফন্দি এঁটেছিলেন বটে, কিন্তু বিধি বাম।

ভাইরা নিজেদের পছন্দে বউ নিয়ে এল ঘরে। শুরু হয় স্বৈরাচারী কর্ত্রীর আসল খেলা। গুটিবাজি আর নোংরা রাজনীতির মাধ্যমে দেশভাগের মতো করেই দুই ভাইয়ের বউদের মধ্যে কোন্দল তৈরি করেন তিনি...ডিভাইড অ্যান্ড রুল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় কি? সেটা অবশ্য সিনেমাতেই দেখা যাবে।

কল্পনার সাহস

সিনেমাটির শেষে একটি সন্তানের আগমন ঘটে, যার নাম রাখা হয় মুক্তি। এই ‘মুক্তি’র মাধ্যমে যেন আসন্ন বাংলাদেশের মুক্তির এক আগাম আশাজাগানিয়া বার্তা দেন জহির রায়হান। যে বার্তায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়, কোনোভাবেই, কোনো নিপীড়নের মাধ্যমেই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘হীরক রাজার দেশে’ ইত্যাদি বাংলা পলিটিক্যাল স্যাটায়ার সব সময়ই অন্যায় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সাহসী বার্তা দেয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে সেই বার্তা অনেক বেশি প্রকট এবং প্রত্যক্ষ।

পরিবার ছাপিয়ে রাষ্ট্র

একটা পরিবার নিয়ে গল্প হলেও, এ কোনো নিছক পারিবারিক গল্পের মোড়কে ফ্যামিলি ড্রামা নয়। দেখতে গিয়ে আমরা উপলব্ধি করি, এ গল্প ঘরের গল্পের চেয়ে অনেক বেশি একটি রাষ্ট্রের গল্প, স্বাধীনতার গল্প, স্বৈরাচারী শাসকের সৃষ্টি করা বৈষম্যের গল্প, জেগে ওঠা জনতার প্রতিবাদের গল্প।

এই ঘরের বাইরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর ভেতরে পরিবারের সদস্যদের ওপর গৃহকর্ত্রীর নিপীড়নমূলক আচরণ। সেই গৃহকর্ত্রী আর কেউই নয়, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের প্রতীকী রূপ এবং তার পরিবারের সদস্যরা হচ্ছে নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনতা।

রূপকের নানান মাত্রা

চমৎকার একটা সমাপনী রয়েছে সিনেমায়। অনেক অত্যাচার সহ্য করে আসা স্বামীটি অবশেষে তার স্ত্রীকে বলেন, ‘হিটলারও ভুল করেছিল। তুমিও ভুল করেছ।’ অর্থাৎ অন্যায়, নিপীড়ন, বৈষম্য কখনো কাউকে সিদ্ধি দেয় না। সিনেমাটিতে রওশন জামিল, খান আতাউর রহমান, রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী, আনোয়ার হোসেন, আমজাদ হোসেনসহ প্রত্যেক কলাকুশলী অসাধারণ অভিনয় করেছেন। খান আতাউর রহমানের সংগীতায়োজন সিনেমাটিকে সার্থকতা দিয়েছে।

সিনেমায় ফ্রিজ শটের দারুণ ব্যবহার করেছেন জহির রায়হান। সেই সঙ্গে রূপক হিসেবে ‘চাবির গোছা’ তো রয়েছেই। বাংলাদেশের যেকোনো প্রভাবশালী সেরা সিনেমার তালিকায় শীর্ষে আছে এই সিনেমা। স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে যে কয়টি সিনেমা বাংলাদেশে হয়েছে, তার মধ্যে তো অবশ্যই। জহির রায়হানের এই অনবদ্য সৃষ্টি আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়ন পেশাজীবী