নীলক্ষেত: যেন পুরোনো বইয়ের গন্ধ শোঁকার স্থান

নীলক্ষেত। বইয়ের রাজ্যে হিসেবে যার খ্যাতি রয়েছে। বইয়ের বাজার বলতেই চোখেমুখে ভেসে ওঠে যার নাম। কম দামে বই কিনতে বইপ্রেমী ও শিক্ষার্থীদের প্রথম গন্তব্য তাই ওই নীলক্ষেত। নতুন–পুরোনো বইয়ের মেলা বসে প্রতিদিন এখানে। তাই বইপ্রেমীদের কাছে নীলক্ষেত জনপ্রিয় দেশি-বিদেশি পুরোনো বইয়ের বাজার হিসেবে। পুরোনো বইগুলো কম দামে তো পাওয়া যায়ই, মিলে যায় অনেক দুর্লভ বইও। বিভিন্ন পাঠাগার ও ব্যক্তির সংগ্রহ থেকে ভালো ভালো বইও এই বাজারে চলে আসে। মার্কেটের দোকান ছাড়াও রয়েছে ফুটপাতের হরেক রকম বইয়ের দোকান। বই ছাড়াও এখানে পাবেন হরেক রকমের প্যাড, ডায়েরি, কলম ও উপহারসামগ্রী।

নীলক্ষেত শুধু ঢাকার একটি জায়গার নাম নয়। নীলক্ষেত শব্দটায় অন্য রকম এক গভীর দ্যোতনা আছে, তাৎপর্য-মাধুর্য আছে। যা এ শহরের পডুয়ারা ঠিকই জানেন এবং বোঝেন। নীলক্ষেত দেশি-বিদেশি পুরোনো বইয়ের আড়ত, যা এক জ্ঞানপীঠের নাম। যে আড়তে ঢুঁ না মারলে বইপ্রেমীদের জীবনই যে বৃথা, এ অনিবার্য সত্যটি যেন এক রকম অবধারিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

সবাই বলে বই মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। আমার কাছে মনে হয় বইয়ের গন্ধ মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। তবে সেটা গন্ধ নাকি সুগন্ধ বোঝার জন্য, অবশ্যই আপনাকে বইপ্রেমিক হতে হবে না। একটা লম্বা নাক থাকলেই হবে। সেই সঙ্গে বইয়ের গন্ধ কীভাবে স্বপ্ন দেখায়, এটা উপলব্ধি করতে আপনাকে অবশ্যই বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। যাদের কাছে চোখ বন্ধ করলেই বই আর নাক খুললেই বইয়ের গন্ধ, তাদের স্বর্গরাজ্য ওই নীলক্ষেত।

ব্রিটিশরা এ দেশে আসার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় নীল চাষ শুরু করে। সেই সময় ঢাকার নীলক্ষেত এলাকার বিরাট প্রান্তরজুড়ে নীল চাষ করা হতো। দীর্ঘকাল ধরে সেই নীল চাষ চলে। প্রচুর নীল উৎপন্ন হতো বলেই আজও নীলক্ষেতের নামের সঙ্গে নীল শব্দটি জড়িয়ে আছে। নীলক্ষেত এলাকার নামকরণ করা হয় নীল চাষের স্থান থেকে। তবে সেগুলো বইয়ের পাতার ইতিহাস। এখন নীলক্ষেতে শুধুই বই চাষ হয় অনেকটা বইয়ের নীল। চাইলেই আপনি হারিয়ে যেতে পারবেন সেই নীল প্রান্তরে।

লাইব্রেরি থেকে আমাদের পড়ালেখা অনেক আগেই ফটোকপি বা শিটে চলে এসেছে। এসবের ওপর নির্ভর করেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চলছে। নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি সে কথাই প্রমাণ করে। নতুন বই কেনার টাকা না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। সব ক্লাসের সব ধরনের পুরোনো বই পাবেন এখানে। সাধারণ জ্ঞান, একাডেমিক বই, চাকরির নিয়োগের বই, মেডিকেলের বই, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই, আইটিবিষয়ক বই, আইনের বই, ইংরেজি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, গবেষণার বইসমূহ, বিবিধ বইয়ের জন্য রয়েছে আলাদা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। প্রথমে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্ররাই ছিল এই বাজারের একচ্ছত্র ক্রেতা। এখন ভর্তি পরীক্ষা, বিসিএস, চাকরির পরীক্ষা, মাদ্রাসা, ইংরেজি মিডিয়াম, সামরিক বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বই, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কোনো ক্ষেত্রই বাদ নেই।

মার্কেটের শেষ দিকে টাইপিং ও বাইন্ডিং দোকানের পসরা। বই কেনার পাশাপাশি পুরোনো বই মেরামত বা বাঁধাই করার সবচেয়ে বড় স্থান হলো নীলক্ষেত। এ ছাড়া বিদেশি ভাষার অনলাইন থেকে নামিয়ে নেওয়া নতুন বই বাঁধাই করার জন্য খ্যাতি রয়েছে নীলক্ষেতের। পুরোনো বই বিক্রি করার জন্য নীলক্ষেত আদর্শ একটি জায়গা। এখানে কম খরচে বই ফটোকপি করে আনতে পারেন এবং ফটোকপি শিটগুলো একদম বইয়ের মতো করে বাঁধাই করে দিতে দক্ষ কারিগর আছেন এখানে।
বেলা দুইটার দিকে ক্যাম্পাস থেকে বের হই। গন্তব্য নীলক্ষেত। নিউমার্কেটের দ্বিতীয় পদচারী–সেতুর নিচে নামতেই মানুষের ভিড়ে যেন মিলিয়ে গেলাম। নীলক্ষেতের আসল চেহারাটা মনে হয় এ রকমই। হাজার হাজার মানুষের ঢল। অতিষ্ঠ হয়ে বিরক্ত বোধ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বইয়ের মার্কেটের ভেতর ঢুকেই হকচকিয়ে গেলাম। এ যেন বইয়ের জনসমুদ্র। মানুষের ভিড় এড়িয়ে এবার যেন বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে গেলাম। ডানে-বাঁয়ে, ওপরে-নিচে, যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু বই আর বই।
বইয়ের মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা কলেজের এক দল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো। এসেছেন বই কিনতে। ইমন আহমেদ, রাজন দেবনাথ ও মেহেদী হাসান—তিন শিক্ষার্থীই সেলফ ডেভেলপমেন্টের বই পড়তে পছন্দ করেন। ইমন আহমেদ জানালেন, সেলফ ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি সাইকোলজির বইয়ের প্রতিও তাঁর আগ্রহ রয়েছে। প্রায়ই বই কিনতে এখানে আসি। আমার কলেজের খুব কাছে হওয়ায় খুব সুবিধা হয়। কম খরচে পুরোনো বই কিনতে পারি। আজকেও একটি বই কিনেছি বলে জানান।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বইগুলোর সিংহভাগই পাশ্চাত্যের ও বিদেশি লেখকদের। এ জন্য ডিপার্টমেন্টের সেমিনারগুলোতে কিছু কিছু বই সংগ্রহে থাকলেও এত দামি দামি বই শিক্ষার্থীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় না। এ জন্য সেমিনার থেকে তারা বই ফটোকপি করে পড়েন। এ ছাড়া নীলক্ষেতের বই মার্কেট থেকে ফটোকপি বই কিনেও অনেকে পড়েন। আবার অনেক শিক্ষার্থী পুরোনো নোট শিটনির্ভর পড়াশোনায় ঝোঁকেন। এর পেছনে একটি কারণ, সিলেবাসের অপরিবর্তনশীলতা। দেখা যায়, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর তৈরি করা এক শিট দিয়েই বছরের পর বছর পরীক্ষা চলছে। যেহেতু পরীক্ষার প্রশ্নগুলোতেও ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বিগত বছরের প্রশ্নগুলো থেকেই করা হয়, তাই এক নোট দিয়েই পার হওয়া যায় খুব সহজেই।

পুরোনো বইয়ের সম্ভারের এই মার্কেটের রাস্তার পাশের ফুটপাতে সাজানো আছে পুরোনো বই, যা পুরোনো বইয়ের মার্কেট বা বাজার নামে পরিচিত। এই ঐতিহ্যবাহী পুরোনো বইয়ের দোকানে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র ভরসাস্থল। স্বল্প দামে ভালো বই পাওয়ায় সবাই এখানে জমান দীর্ঘ লাইন। অল্প খরচেই বই কিনে যেমন নিজের প্রয়োজন মেটান শিক্ষার্থীরা, তেমন বই বিক্রির অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে শত শত পরিবার।

নীলক্ষেতের ফুটপাতে বই বিক্রি করতে দেখা যায় মোহাম্মদ মাহিন নামের একজনকে। কথা বলে জানতে পারি, ২২ বছর ধরে তিনি বইয়ের ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন ধরনের নতুন–পুরোনো বই রয়েছে তাঁর দোকানে। বললেন নতুন বইয়ের চেয়ে পুরোনো বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি পাঠকদের। তাই তাঁদের চাহিদামতো বই রাখি। এখন উপন্যাসের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সামনে বইমেলা। বেচাবিক্রি বাড়ার আশা তাঁর। তিনি আরও জানান, দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার মতো বই বিক্রি হয়। পুরোনো বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় মে, জুন ও জুলাই মাসে। এ সময় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শুরু হয়। এ ছাড়া অনার্সে ভর্তি চলে। ফলে তাঁদের বেচাকেনা তুলনামূলক বেড়ে যায়।

নতুন বই কোনটি
বলা হয়ে থাকে, যে বইটি পড়া হয়নি, সেটিই আসলে নতুন বই। বই কবে প্রকাশিত হলো, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন পাঠক। তাঁদের কাছে আজকে যে বইটি প্রকাশ হলো সেটি যেমন নতুন, একইভাবে অনেক বছর আগে প্রকাশ হওয়া অপঠিত বইটিও নতুন। শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো যুগান্তকারী সাহিত্যিকদের বই নয়, বরং পরবর্তী সময়ের অনেক কীর্তিমান সাহিত্যেকের বইও বিক্রি হচ্ছে নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতে।

নীলক্ষেতের পুরোনো বই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, এসব বই বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। সবই যেহেতু পুরোনো বই, তাই এগুলো কেউ না কেউ বিক্রি করার পরই নীলক্ষেতের বাজারে আসে। সাধারণত ভাঙারির দোকান, বাংলাবাজার ও ফেরিওয়ালার কাছ থেকেই বইগুলো বাজারে ওঠে। মাঝেমধ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রন্থাগার থেকেও পুরোনো সংস্করণের বইগুলো আনা হয়। অনেকে আবার ব্যক্তিগত সংগ্রহের বইও বিক্রি করেন।

পুরোনো বই বিক্রেতা আবদুল লতিফ মিয়া বললেন, ‘২০ বছর হইয়া গেছে পুরান বই বেচতাছি। আমরা সব ধরনের বই-ই বেচি। এখানে পাওয়া যাইব না এমন কোনো বই নাই। যেসব বই আর নতুন পাওয়া যাইবো না, সেগুলার পুরান সংস্করণও এইখানে আছে। তয়, খুঁজে নিতে হইবো।’

নীলক্ষেতের এ বাজারে মিলবে ইংরেজি মিডিয়াম এবং বাংলা মিডিয়ামের সব বই। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব বিভাগের সব ধরনের বইয়ের দেখা পাবেন এখানে। এমনকি গবেষণার ওপরও পাওয়া যাবে নানা রকম বিষয়ভিত্তিক বই। পাঠ্যবই ছাড়াও রয়েছে গল্প, কবিতা, কৌতুক, সাধারণ জ্ঞান, চাকরি ও ভর্তির প্রস্তুতিমূলক সহায়ক বই। পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন ইংরেজি বইও নজরে পড়বে এ বইয়ের বাজারে।

ঘুরতে ঘুরতে একটি পুরোনো ইংরেজি বইয়ের দোকানে দেখা হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁর নাম ইসমাত জাহান অন্তরা। তিনি বললেন, ‘আগে খুব বেশি আসতাম, এখন সে রকম সুযোগ পাই না, তবে মাঝেমধ্যেই আসি। এমন অনেক বই আছে, যেগুলো এখানে ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মূলত বিষয়ভিত্তিক বই-ই কিনি। এই যেমন পেশাগত পদ্ধতি, ধর্মীয় ইতিহাস, পরিসংখ্যান, পরিবহন ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং নগর-পরিকল্পনা। মনে ধরলে গল্প-কবিতার বইও কিনি।’

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি। একজন বয়স্ক লোককে হেঁটে যেতে দেখলাম। পরক্ষণেই তাঁর চলার গতি কমে গেল। হঠাৎ ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের মাঝে তাঁর চোখ আটকে যায়। বইটি হাতে নিয়ে কিছু সময় পাতা ওলটাতে লাগলেন। বেশ মলিন বইটি। নিমেষেই বইটি হাতে নিয়ে তার মূল্য জানতে চাইলেন। বিক্রেতা জানালেন ২০০ টাকা। তা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই নেই কোনো চিন্তা কিংবা আবেগ। বইটি কিছুটা মলিন হওয়ায় দরদাম করে ১৫০ টাকায় কিনে নিলেন লোকটি।

জাকির হোসেন নামে আরেকজন বিক্রেতা বলেন, ‘কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই বেশি আসে। এখানে আইসা কেউ বই বেচে দেয়, কেউ কেনে। চাকরি, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বই আর পাঠ্যবই-ই বেশি বিক্রি হয়। গল্পের বইও বেশ চলে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়