ফেসবুক বনাম বাস্তবতা

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

আজকাল ফেসবুক খুললেই দেখা যায় এর পেজের শেষ নেই, সেই সঙ্গে আছে অগণিত ভ্লগ। কেউ টেবিলভর্তি খাবার নিয়ে বসে আছেন, কেউবা প্রসাধনী। শুধু তা–ই না, আরও আছে জামা, জুতা, কাপড়চোপড়, ব্যাগ, স্যান্ডেল, সাজসজ্জা, স্টেজসজ্জা, পার্টিসজ্জা, বিয়ের ডালা, হলুদের ডালা, জন্মদিনের কেক, নিজের শাড়ি, টাই, বাচ্চার খেলনা, কীভাবে রান্না করতে হয়, কীভাবে খেতে হয়, কীভাবে হাঁটতে হয়, কীভাবে কথা বলতে, কীভাবে বাথরুম পরিষ্কার করতে হয় ইত্যাদি আরও কত কি।

সবকিছুতেই চাকচিক্য, ন্যাকামি, রং, ঢং ইত্যাদি মিলিয়ে শো অফ করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এসব যে যত বেশি দেখাতে পারে, তার পোস্ট অথবা পেজে তত বেশি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ইত্যাদি পাওয়া যায়।

এসব যাঁরা দেখেন, তাঁদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তাঁদের মধ্যে অবাস্তবকে পাওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। তাঁরা যত বেশি এসব দেখছেন, তত বেশি জীবনটাকে জটিল করে ফেলছেন। তাঁরা ভাবছেন জীবনটা হয়তো এ রকমই। সব সময় জুয়েলারি পরে সেজেগুজে বসে থাকা, বাফেটে ডিনার করা, নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাক পরা, এসব দেখে কেউ কেউ মনে করেন যে লাইভে আসা ব্যক্তিরা হয়তো এভাবেই তাঁদের জীবন পার করে দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়।

আমরা স্ক্রিনে সবকিছুই দেখি কিন্তু একটা জিনিস দেখি না যে এসব জিনিস সব ‘ফ্রি ফর প্রমোশন’। যাঁরা এসব করছেন, তাঁরা বেশির ভাগই মডেল। এটা তাঁদের পেশা। যাঁরা এ পণ্যগুলো তাঁদের দেন তাঁরা তাঁদের পণ্য প্রমোট করার জন্য দেন। লাইভ করে দিন শেষে মডেলরা এসব পণ্য যথাযথ জায়গায় ফেরত দিয়ে বাড়ি ফেরেন। অর্থাৎ এসব কিছুই তাঁদের নয়।

এ পেজগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো পণ্য বিক্রি। আমরা দেখি। দেখে আমাদের কেনার ইচ্ছা হয়। সামর্থ্য অনুযায়ী কিনি। অন্যদের কিনতে বলি। এটাই হলো ফেসবুকের এ পেজগুলোর মূল উদ্দেশ্য।  তবে কখনো কখনো এ পেজগুলোর অতিমাত্রায় চাকচিক্যে আকৃষ্ট হয়ে আমরা মূল বিষয় উপেক্ষা করে ফেলি। যেমন বিয়ের সময় পাত্রের যোগ্যতার খোঁজখবর না নিয়ে কোন জিনিসটা কোনো পেজ থেকে কিনতে হবে, সেই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে যাই।

যেমন একটি বিশেষ পেজের লেহেঙ্গা না কিনে দিলে বিয়ের সাজ পরিপূর্ণ হবে না, আমাকে দেখতে ক্রিম আপ্পির (ছদ্মনাম) মতো লাগতে হবে। কেকটা কেক আপ্পির (ছদ্মনাম) কাছ থেকে কিনতে হবে ইত্যাদি। এসব দেখে আমাদের মধ্যে একধরনের unrealistic expectation তৈরি হয়। ফলে আমরা নিজেদের ওপর, পরিবারের আর্নিং সদস্যদের ওপর একধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করি। এর অপ্রাপ্তি জীবনে বিষণ্নতা ও হতাশার উদ্রেক করে।

ব্যাপারটি কখনো কি চিন্তা করে দেখেছি যে কী আছে ওই ৭০ হাজার টাকা দামের লেহেঙ্গায় বা কী আছে ওই ৪৫ হাজার টাকা দামের শাড়িতে। ঠিক ওই লেহেঙ্গা বা ওই শাড়ি না কিনে একই রকম অন্য একটি কেনা যায়। কারণ, এত টাকা খরচ করে যা কেনা হলো, তা কয়টি অনুষ্ঠানে পরা যাবে, ভেবে দেখেছি কখনো? খুব বেশি হলে তিন থেকে চারটি। তারপর আবার আরেকটি কিনতে ইচ্ছা হবে। এভাবে আমরা আমাদের জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম, আয়েশ সবকিছু ফেসবুকের কাছে বিলিয়ে দিয়ে কেউ উদ্বিগ্নতায় ও হীনম্মন্যতায় ভুগছি, কেউবা স্বেচ্ছায় অসুখী জীবন যাপন করছি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক। ডিজিটাল মার্কেটিং খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি। ফেসবুক মার্কেটিং অত্যন্ত সহজ একটি বিষয়। শুধু একটি পেজ খুলে টার্গেট ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় পণ্যের সমাচার। এখানে না আছে কোনো দায়বদ্ধতা, না আছে সেন্সরশিপ, বয়সের বাধ্যবাধকতা কিংবা ভাষার বাছবিচার।

ব্যবহারকারীরা স্ক্রল করলেই দেখতে পারেন যেকোনো পণ্যের পেজ অথবা ভ্লগ। কথার চাটুকারিতায় আর ভারী মেকআপ করা বাহারি চেহারা দেখে অনেকেই তোষামোদিত হয়ে যান। এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে যে সবকিছু সবার জন্য নয়। নিজের সাধ্য, সামর্থ্য ও সামাজিক অবস্থানের কথা সবার আগে ভাবতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুকের সীমিত ব্যাবহার মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এ বিষয়ে আমাদের এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।  

লেখক: ফারজানা বেগম, সিনিয়র শিক্ষক, অ্যাপল ট্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল