বৈশাখের মালিকানা ফিরেছে জনগণের কাছে

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সিলেট জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বর্ষবরণ শোভাযাত্রা বের করা হয়। ছবিটি সকালে নগরের কোর্টপয়েন্ট থেকে তোলাছবি: আনিস মাহমুদ

বাংলা বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ কেবল একটি দিন নয়; এটি একটি চেতনার নাম, একটি জাতিসত্তার প্রকাশ, বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অমোঘ নিদর্শন। বহু শতাব্দী ধরে এই উৎসব বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে কালের বিবর্তনে, নানা রাজনৈতিক সংকট আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবও কখনো সংকুচিত হয়েছে, কখনো হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতীক যেন আটকে ছিল কিছু নির্দিষ্ট বলয়ে, একটি দল বা ঘরানার নিজস্ব আয়োজন হিসেবে। চারুকলাকেন্দ্রিক আয়োজন এবং সেই পরিমণ্ডলে বাম ঘরনার অংশগ্রহণকারীদের একাধিপত্য এই উৎসবকে একরকম ‘নির্দিষ্ট মানসিকতার’ সাংস্কৃতিক বলয়ে আবদ্ধ করে রেখেছিল। এবারের বৈশাখ সেই নীরব অবরোধ ভেঙে দিয়েছে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে উৎসবে মেতে ওঠা এবং শহরের সীমানা পেরিয়ে গ্রাম পর্যন্ত এর ছোঁয়া—সব মিলিয়ে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি যেন ছিল এক সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বৈশাখের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায়, এই উৎসব কখনোই কোনো একক গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল না। মোগল সম্রাট আকবর কৃষিব্যবস্থাকে সংগঠিত করতে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় সহজ হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হিসাবের বর্ষপঞ্জি পরিণত হয় উৎসবে, পরিণত হয় বাঙালির মাটির সঙ্গে মিশে থাকা সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশে। গ্রামীণ বাংলার বৈশাখ তাই ছিল বটতলার মেলা, হালখাতা, ঢাকঢোল, নাচ-গান, আর লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবির আনন্দ। মানুষের মুখে মুখে থাকা পল্লিগীতি, মুরব্বিদের মুখে নতুন বছরের শুভেচ্ছা, আর বাচ্চাদের হাতে বাতাসা-মুড়ির ঠোঙা—এসব ছিল এই উৎসবের বাস্তবরূপ। এটি কখনোই শহরের চারুকলা বা ছায়ানটের একক সত্তা ছিল না। তবে শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার ছোঁয়ায়, বৈশাখ ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও রাজনৈতিক বলয়ের দখলে চলে যেতে থাকে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের পরবর্তী সময়ে, যখন জাতীয়তাবাদী চেতনার বিপরীতে দাঁড় করানো হলো বাঙালি সংস্কৃতিকে, তখন আওয়ামী লীগ এবং সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বৈশাখকে তাদের পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার করে তোলে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানটের রমনা বটমূলে গান—এসব হয়ে ওঠে বৈশাখের মূল চিত্র। অথচ এতে গ্রামীণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না, ছিল না পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী, সাঁওতাল, রাজবংশী, চাকমা কিংবা মারমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব।

এই একচেটিয়া সংস্কৃতিচর্চা একসময়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে ধর্মীয় রক্ষণশীলদের একটি বড় অংশ এবং রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের কাছে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে একটি ‘লিবারেল’ বা ‘আওয়ামী’ উৎসব। এই মনোভাব সমাজে যে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করেছিল, তা আমাদের জাতিসত্তার বহুবাচনিক রূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এবারের বৈশাখ ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। শহর আর গ্রাম একসঙ্গে মিশে গেল যেন এক সুতায় বাঁধা উত্সবে। আর এই উত্সব ছিল সবার—কেবল প্রগতিশীল বা বাম ঘরানার নয়, কেবল রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশ্বাসীদের নয়, বরং প্রত্যেক সেই মানুষের, যিনি নিজেকে বাঙালি বলে ভাবেন।

এ বছর রাজপথে যেমন ছিল ছায়ানটের গান, স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের নাচ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে র‍্যালি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক–অরাজনৈতিক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত লোকজ মেলা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, কোথাও গ্রামের স্কুলমাঠে ব্যানারহীন বৈশাখী অনুষ্ঠান, আবার কোথাও পাহাড়ি অঞ্চলে মারমা বা ত্রিপুরা সংস্কৃতির অংশ নিয়ে বৈশাখ উদ্‌যাপন। এসব আয়োজন প্রমাণ করেছে—মানুষ নিজের উৎসব নিজের মতো করে ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই অংশগ্রহণ শুধু সাংস্কৃতিক নয়, একধরনের রাজনৈতিক প্রতিবাদও বটে। উৎসবের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রত্যাখ্যান করে মানুষ এবার বলেছে—এটি তাদের দিন, তাদের আনন্দ, তাদের পরিচয়। এটা যেন ছিল নিঃশব্দ এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান—যেখানে না আছে দলীয় পতাকা, না আছে আদর্শগত হম্বিতম্বি; আছে কেবল ভালোবাসা, শিকড়ের টান আর জাতিসত্তার মৃদু অথচ দৃঢ় ঘোষণা।

বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা—যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

সুতরাং এবারের বৈশাখ একটি বার্তা দিয়েছে—সাংস্কৃতিক মালিকানা ফিরে যাচ্ছে জনগণের হাতে। আশা করি, এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বৈশাখ হবে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ, আরও অংশগ্রহণমূলক অর্থাৎ সব ধরনের রুচি, চিন্তা ও সংস্কৃতিকে ধারণক্ষম। এই সমাজচিত্রই হোক আগামীর বাংলাদেশ—যেখানে উৎসব মানে বিভাজন নয়, বরং মিলনের সেতুবন্ধ।

*লেখক: শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়