বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করছে ‘বাংলায়ন সভা’। ‘বাংলা বিশ্বময়’ স্লোগান নিয়ে ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। কার্যক্রম হিসেবে সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে সংগঠনটি নিয়মিত ‘শিল্প-সাহিত্যের বৈঠক’ শিরোনামে নিয়মিত সভার আয়োজন করে আসছে। ৩ সেপ্টেম্বর ছিল সংগঠনটির বর্ষপূর্তির আয়োজন। ওই দিন বিকেলে এ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার হলে। এবারের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশ্বায়নে অন্তরায় এবং উত্তরণের পথ’।
অতিথিদের ফুলের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে আরম্ভ হয় অনুষ্ঠান। উল্লিখিত বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমির মহাপরিচালক নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হাকিম আরিফ। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলায়ন সভার সম্পাদক ফারুক সুমন এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সমন্বয়ক গাজী মুনছুর আজিজ ও লেখক সুরজিৎ রায় মজুমদার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলায়ন সভার মুখপাত্র শামস সাইদ। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ। কবিতা পাঠ করেন কবি আদিত্য নজরুল, শাকিরা পারভিন, স্নিগ্ধা বাউল, আজিম হিয়া, শান্তা মারিয়া, বিধান সাহা, আশরাফ জুয়েল, সেঁজুতি বড়ুয়া ও মামুন অপু।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, মানবতাবাদী মনীষীদের বিশ্বভ্রাতৃত্বের মহাবয়ান আর বিশ্বায়নের ধারণা এক নয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বরাবরই চায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যেন বিকশিত না হয়। এ জন্য তারা নানাভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাখে। এমনকি বাংলাদেশও নানা দিক থেকে বিশ্বায়নের চাপে আছে। ফলে আমাদের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিও বিশ্বায়নের চাপে রয়েছে। আর সে কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বময় খুব বেশি ছাড়াতে পারেনি। অবশ্য রাষ্ট্র হিসেবেও আমাদের দেশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বময় ছড়াতে খুব একটা উদ্যোগ নেয়নি। এ ছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বাংলা একাডেমির যে কাজ করার দরকার ছিল, তারাও এ বিষয়ে কাজ করছে না। ফলে নানাভাবেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বায়নের পথে এগোতে পারেনি। অথচ এ বিষয়ে রাষ্ট্রেরই উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার ছিল।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হলে প্রতিটি দেশে বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বময় ছড়াতে হলে বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হাকিম আরিফ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষার দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা। কিন্তু এখনো আমাদের শিক্ষানীতিতে বাংলা ভাষার বিষয়টি অনুপস্থিত। তাই আমাদের নিজেদের যেমন বদলাতে হবে, তেমনি রাষ্ট্রকেও ভাষার প্রচার-প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া গত ১০০ বছরে বিশ্বের যত ইনোভেটিভ ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশই হয়েছে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। সে তুলনায় আমাদের বাংলা ভাষার অনুবাদ একেবারেই কম হয়েছে। ফলে বিশ্বের মানুষ জানতেও পারছে না আমাদের সাহিত্যে কী ঘটছে। সে জন্য এখন দরকার বাংলা সাহিত্য বেশি বেশি ইংরেজিতে অনুবাদ করা। এ ছাড়া আমাদের পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে আমরা যেমন মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ ব্যবহার করছি, তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। আর এসব উদ্যোগ রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।’ আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে অতিথি এবং সম্পাদনা পর্ষদ মিলে ‘বাংলায়ন বার্ষিকী’ প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করে। প্রকাশনাটিতে ছাপা হয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক ২৫টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত হওয়া এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি-সাহিত্যিকসহ প্রায় ১০০ দর্শক-শ্রোতা।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কবি সৌম্য সালেক ও চামেলী বসু। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগী ছিল ই-শিখন ডটকম ও ফ্যাশন হাউস বালুচর।