দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায়
মফস্সল শহর রংপুর। অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা শেষ। কিছু বই বিক্রি করে ৩৫ টাকা পেয়েছি। তাই নিয়েই ছুট পরিচিত এক দোকানে, তখন রেডিও-ক্যাসেটের যুগ। চাই রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট। শুনতে হবে সাদি মহম্মদের গান। বাড়িতে বাজবে সেই অসাধারণ কণ্ঠ, কী যে আনন্দ! সে সময় আমাদের মতো মফস্বল শহরের ছোট-বড় প্রায় সব বাড়িতেই গান শোনার তুমুল চল ছিল। টিভি থাকলেও এত চ্যানেল তো ছিল না। ইন্টারনেট তো সুদূর কল্পনাতেও নেই। আমাদের আনন্দ-বিষাদ কাব্যের অনেকটুকু জায়গাজুড়ে তাই ছিল রেডিও আর টেপরেকর্ডার। হিন্দি, আধুনিক বাংলা, ব্যান্ড—কী ছিল না তাতে। সব ছাপিয়েও রবীন্দ্রসংগীত আর সাদি মহম্মদ যেন ছিলেন অনন্য।
কী কপাল আমার! যার গান শুনে রবীন্দ্রনাথ আপন হয়েছিলেন, অনেক বছর পরে এসে সেই সাদি স্যারের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হওয়ার, মুখোমুখি কথা বলারও সুযোগ হল। সুযোগ করে দিল মেয়ে। যেদিন প্রথম স্যারের সঙ্গে দেখা, মাথায় কিছু আসছিল না। ভাবছিলাম, দেখা হলে কী বলবো? মুখে সালাম দেব, না কি পা ধরে সালাম করব? আরও অনেক কিছু। মেয়েকে গান শেখানোর উদ্দেশ্যে সাদি স্যারের দরজায় হাজির হয়েছিলাম। শেখান বলতে, উনি আসলে গান ভালোবাসতে শেখান। সেই শুরু। এর পরের দুই বছর, তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, তিনি যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। মেয়ের গান শেখার বদৌলতে, সাদি স্যারের সঙ্গে আমাদের সব মায়েদেরও একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমরা স্যারকে মাথায় করে রাখতাম, মনে হতো একজন জীবন্ত কিংবদন্তির সামনে বসে গান শুনছি। কী ভাগ্য!
সাদি স্যারের ক্লাসে শুধু কী গান, কত গল্প, কত স্মৃতিচারণা যে ছিল। সেখানে তার কণ্ঠেই শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরিবারের অনন্য আত্মত্যাগের কথা, বুয়েট ছেড়ে গানের প্রেমে পড়ে কীভাবে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন, আরও কত কি। ঘরের খবর, হাঁড়ির খবর বিনিময় তো থাকতই।
কারো কোনো উপলক্ষই লাগতো না তার বাসায় যেতে; কালের সাক্ষী ওই বাড়ির দরজা কখনো বন্ধ হতো না। সবার অবাধ যাতায়াত ছিল। যেতে চাইলে চারতলা পর্যন্ত বিনা বাধায় ঢুকে যাওয়া যেত। ছাত্র-ছাত্রীদের, ছোট বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসতেন। কারও চুল এলোমেলো, উনি চুল ঠিক করে দিতেন। একদম তাড়াহুড়া পছন্দ করতেন না। কেউ জোরে হাঁটলে এই তুই এত জোরে হাঁটলি কেন, এমন তাড়াহুড়া করলে আমার বুক ধড়ফড় করে।
গানের ক্লাস তো ছিলই, কতবার যে তিনি আমাদের ডেকে খাইয়েছেন। উনি রান্না করলেই আমাদের দাওয়াত। বাচ্চাদের কারও জন্মদিন হলে তো কথাই নেই, যেন আনন্দের হাট বসে যেত সেদিন। সেসব দিন যে আর ফিরে আসবে না, এই দুঃখ কোথায় রাখি!
স্যার বড্ড আবেগী মানুষ ছিলেন; প্রায়ই বলতেন, আমার কিছুই ভালো লাগে না, কেন যে বেঁচে আছি। একদিন বলেছিলাম, স্যার একদিন মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবেন, শুনবো। উত্তরে স্যার বললেন, ‘গল্প আর কি বলব, গল্প তো নাই। আছে শুধু স্মৃতি আর দুঃখ।’
সাদি স্যারের পরিবার সম্পর্কে, বিশেষ করে তাঁদের দুই ভাই সম্পর্কে তো এই দেশের সবাই জানে। দুই ভাইই অসাধারণ। নাচ নিয়ে কিংবদন্তি হয়ে আছেন শিবলী স্যার, গানে সাদি স্যার। এমন পরিবার এ দেশে খুঁজে পাওয়াই তো মুশকিল। শিবলী স্যার যেমন মুখের ওপর সব বলে দেন, খারাপ ভালো দুটোই; তার ভেতর কোনো ভণিতা নেই, এতে কেউ তাকে খারাপ বললেও তার যায় আসে না। সাদি স্যার ছিলেন খানিকটা উল্টো; তাঁকে কেউ কিছু বললে মন খারাপ করে ফেলতেন, নিজের ভেতর কুঁকড়ে যেতেন। কারও কথায় কষ্ট পেলে লুকিয়ে রাখতেন। যেদিন অসুস্থ থাকতেন, বা মন খারাপ থাকতো, আমরা বুঝতে পারতাম। মনে হতো, সেদিন যেন আরও বেশি গান গাইতে চাইছেন, গানেই আশ্রয় খুঁজছেন।
মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। শেষদিকে স্যারের দাঁড়াতে কষ্ট হতো, কাঁপতেন। দুই হাঁটুতে অপারেশন করালেন, যেন পায়ের শক্তি দিয়ে দাঁড়াতে আর হাঁটতে পারেন। এখন তো মনে হয় অপারেশন না করলেই হয়তো ভালো হতো।
স্যার যেদিন মারা গেলেন, সেদিনের ওই মুহূর্তগুলোকে এখনো অবিশ্বাস্য লাগে। মেসেঞ্জারে মেসেজ পেলাম, সাদি স্যার আর নেই। বিশ্বাস করলাম না, যে মেসেজ পাঠিয়েছে উল্টো তাকে ফোন দিয়ে বকা দিলাম যে আপনারা এসব ভুয়া নিউজ কেন ছড়ান? উনি বললেন, আপা আপনি টিভি দেখেন। কাঁপা কাঁপা হাতে রিমোট চাপলাম। অবিশ্বাস্য! কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। মেয়ে জিজ্ঞেস করছে, কাঁদছো কেন? কিন্তু আমার মুখে কথা ফুটছে না। কীভাবে মেয়েকে এই সংবাদ দেব? কীভাবে বলবো তার প্রিয় সাদি স্যারের সঙ্গে আর কখনোই দেখা হবে না। ধাতস্থ হয়ে আধঘণ্টা পর যখন বললাম মেয়েও বিশ্বাস করতে চাইছিল না।
আমার দশে পড়া মেয়ের এখনও চাওয়া, স্যারের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাক। হয়তো হঠাৎ করে আবার ডাকবেন, বলবেন, ‘তোর চুলের ক্লিপটা ঠিক করে দিই এভাবে, এলোমেলো আসবি না। তোরা আবার ওই গানটা গা তো।’ সুন্দর না হলেও মিথ্যামিথ্যি বলবেন, ‘বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে। বাসায় আরেকটু চর্চা করিস।’
সাদি স্যারের জীবনের যে ব্যপ্তি, তা ফুটিয়ে তোলার যোগ্যতা, সাহস কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু এটুকু বলতেই পারি, শিল্পী হিসেবে তো বটেই, স্যার মানুষ হিসেবেও যে কত বড় মাপের ছিলেন, এখনকার অসুন্দর, অবিশ্বাসের যুগেও তিনি যে কত বড় মহীরুহ ছিলেন, তা তার আশপাশের লোকজন প্রতিনিয়তই টের পাচ্ছেন।
সাদি মহাম্মদকে এই রাষ্ট্র কী দিতে পারতো, না পারতো—সেই আলোচনায় যাবো না। নিজেরই ভীষণ লজ্জা লাগছে এটা লিখতে গিয়ে, স্যারও আলোচনা করতে নিষেধ করতেন। আমরা তো সেই অভাগা জাতি, যারা জীবিত থাকতে বীরদের মর্যাদা, যোগ্য সম্মান দিতে জানি না। শিবলী স্যার, কিংবদন্তি শিল্পী। অথচ কোনো নাচের অনুষ্ঠান করতে গেলে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হিমশিম খান, যেন তার একারই দায়িত্ব নাচকে এগিয়ে নেওয়ার। রাষ্ট্র, সমাজের কোনো দায় নেই! টিভি চ্যানেল বা কোনো অনুষ্ঠান—দেখা যায় সেখানে নাচ ঠিকই আছে, কিন্তু কোনো নৃত্যশিল্পী নেই, মডেল দিয়েই কাজ চলে যায়। শিল্প, শিল্পীর চেয়ে গ্ল্যামারের অশ্লীল রমরমা দাপট। আর আমরা হাহুতাশ করে মরি সংস্কৃতির পড়ন্ত দশা নিয়ে। কী হিপোক্রেসি!
স্যার মারা যাওয়ার আগে আগে বাচ্চাদের ‘দেখো দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায়…’ গানটি শেখাচ্ছিলেন। গানটা শেষ হওয়ার পর বললেন, ‘তোরা কি শুকতারা দেখেছিস কখনো?’ বাচ্চারা জানালো দেখেনি, জিনিসটা কি তারা বোঝেও না। স্যার এরপর সব মায়েদের বললেন, আজকে সন্ধ্যায় বাচ্চাদের শুকতারা দেখাবে। এরপর শুকতারা নিয়ে বাচ্চাদের বুঝিয়ে বললেন। পরে বললেন, ‘তোরা শুকতারা দেখে এসে আমাকে বলবি।’ তার দিন কয়েকের মাথায় তিনি মারা যান।
এখনো প্রায় সন্ধ্যায় স্যারের গান শুনি। মনে হয়, স্যার কি শুকতারা হয়ে আছেন? আমাদের দেখছেন আর হাসছেন? আজ জন্মদিনেও (৪ অক্টোবর) কী আপনি শুকতারা হয়ে এসেছেন স্যার? তবে আকাশ পানে চেয়ে বলি, শুভ জন্মদিন স্যার।