শৈশব ও শীতের পিঠা
আজ বহু বছর পর গ্রামের বাড়ির শীতকালের কথা মনে পড়ল। মাঝেমধ্যে যে মনে পড়ে না, তা নয়। তবে আজ স্মৃতিগুলো যেন একেবারে সাদাকালো সিনেমার কোনো দৃশ্যের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল। বোধ হয় ঢাকা শহরের এমন কুয়াশাছন্ন সকালটাই এর জন্য দায়ী।
ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ার সময় বাংলা বইয়ে একটা গল্প পড়তাম ‘শীতের পিঠাপুলি।’ গ্রামে গেলে এ গল্পের সঙ্গে একদম মিলে যেত।
প্রায় দুই যুগ আগের গ্রামের শীতটা ছিল একদম হাড়কাঁপানো। আগের রাতে সন্ধ্যায় খাবারটা খেয়েই সবাই ঘুমিয়ে যেত। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই বাড়ির কর্তা গৃহিণীরা উঠে যেতেন। আমরাও একদম কাকডাকা ভোরেই উঠে পড়তাম। উঠে দেখতাম চারদিকে পিঠা বানানোর ধুম। চারপাশে খেজুরের গুড় আর নারকেল মাখার সুমিষ্ট ঘ্রাণ। হু হু করে শীতে কাঁপতে কাঁপতে মুখ ধুয়েই এসে বসতাম মাটির চুলার পাশে। দুই হাত ঘষে চুলার দুই পাশে একটু দূরে হাত রেখে আগুনের তাপ নিতাম। বেশ আরামদায়ক ছিল ব্যাপারটা।
নানু পিঠা বানাচ্ছেন আর মা-খালারা কেউ চালের গুঁড়া কুটছেন, কেউ ছাঁকনি দিয়ে চেলে দিচ্ছেন আর কেউ মাটির সরায় পিঠার আকৃতি দিচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ‘ভাপা পিঠা’ আর ‘দুধচিতই’ পিঠার কথা। আমাদের গ্রামে দাদু–নানু কিংবা অন্য মুরব্বিরা যে সাইজের ভাপা পিঠা বানাতেন, তা দেখার মতো। একেকটা ছোটখাটো থালা সাইজের! আমরা ছোট ভাইবোনেরা কোনোরকমে আধখানা খেয়েই সাড়া! মামা-চাচাদের অবশ্য দুই-তিনটায় বেশ হয়ে যেত! প্রায়ই তাঁরা আমাদের মজা করে বলতেন দেখি আজকে কে বেশি খেতে পারিস। দুটি পিঠা খেলে দুই টাকা আর চারটা খেতে পারলে পাঁচ টাকা! সাত টাকা তখন চকবারের দাম, নয় টাকায় পাওয়া যায় একটা কোকাকোলা! মনে মনে সবাই চারটা খাওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে মিশনে নামলেও একটাই শেষ হতো না!
হাত–মুখ ধুয়ে এলে নানু বিশাল হাঁড়ি, যেটাকে কি না ড্যাগ বলে তার ঢাকনা উঠিয়ে দিত। ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে দুধচিতইয়ের সুঘ্রাণ, সারারাত নারকেলের গুড় মেশানো দুধে ভিজে পিঠাগুলো ফুলেফেঁপে উঠত। টিনের প্লেটে বিশাল সাইজের আস্ত একটা পিঠা দিয়ে তার ওপর ঢেলে দেওয়া হতো নারকেলের গুড়ের দুধ! আহ্...কী সেই স্বাদ! ভাবতাম দুনিয়ার খাবারই এত মজা বেহেশতে না জানি কত মজার খাবার পাওয়া যায়!
খেয়েদেয়ে এবার পাড়া বেড়ানোর পালা! প্রথমেই গন্তব্য দাদুর বাড়ি। নানু-দাদুর বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় বিশাল সুবিধা পেয়েছি। তাদের বেঁচে থাকা পর্যন্ত একবার গ্রামের বাড়ি গেলে দ্বিগুণ আদর পেয়েছি। সকালে নানুর বাসা তো বিকালে দাদুর বাসা। এভাবেই দিন কাটত।
দাদুর বাসায় গেলে দেখা যেত তিনি আবার ভাপা চিতইয়ের সঙ্গে সেমাই পিঠাও বানাচ্ছেন! ছোট পাকস্থলীতে এত জায়গা না থাকায় দাদুর বাড়ির পিঠা বরাদ্দ রাখতাম রাতের জন্য।
সমবয়সী চাচাতো–মামাতো ভাইবোন আর প্রতিবেশীদের দুই–চারজন সঙ্গী নিয়ে গড়া ছোটখাটো দলের আমরা বেড়িয়ে পড়তাম এরপর অন্যদিকে। যেখানে যাই সেখানেই পিঠা। পুরো গ্রামে যেন উৎসব লেগে গেছে! এখন কত সময়, কত শিডিউল কত দিক চিন্তাভাবনা করে পরিবারের আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে পিঠা উৎসব করতে হয়। ভেবে পাই না আগে এত মানুষ গ্রামের বাড়িতে শীতকালে জড়ো হতো কী করে! তখনো তো আমাদের বাবা-চাচাদের অফিস আদালত ছিল, মামাদের কলেজের ক্লাস ছিল। আসলে তখনও সবার ব্যস্ততা ছিল কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাত ছিল না। তাই হয়তো সবাই এক হতে পারতাম। দিনগুলো খুব মনে পড়ে। এখন আর খুব একটা শীতের পিঠা খাওয়া হয় না। বাংলায় এখন কফি আর পাস্তাই ভরসা। নানু-দাদুর পর মা খালাদের হাত ঘুরে এখন শীতের পিঠা প্রায় বিলুপ্ত। পিঠা খেতে চাইলে বেশির ভাগ সময় এখন তাই রাস্তার পিঠাওয়ালা মামা-খালারাই ভরসা। মাঝেমধ্যে দেখি তাঁরা মহাব্যস্ত যে আজ অমুকের ৫০টি ভাপা পিঠা তমুকের ১০০ চিতই পিঠার অর্ডার আছে! মানুষের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন আর সময়ের কারণে আজ আর সেই শীতের পিঠা নেই। নেই কোনো উৎসব। নগর দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে সব আবেগ।
লেখা: রবিউন নাহার তমা, শিক্ষক ও লেখক